শাফায়াত তৌসিফ
‘জীববৈচিত্র্য’ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে বিস্ময়কর এবং দুর্লভ কিছু অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছিলাম! জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, জাগুয়ার, ভালুক, কুমির এবং জলহস্তির মতো অত্যন্ত হিংস্র এসব প্রাণীদের খুব কাছাকাছি গিয়ে কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত বিশেষ গাড়িতে চড়ে ওদের গতিবিধি ও জীবনাচরণের নানা দিক সম্পর্কে আমাকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়েছিল!
এছাড়াও হাতি, জিরাফ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, নীলগাই, প্যাটাগোনিয়ান মারা, হরিণসহ এই ধরনের কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে তাদেরকে কোনো রকম বিরক্ত না করে এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তাদের সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানতে চেষ্টা করেছি।
আর এই পুরো কাজটি কিন্তু বন অধিদফতরের (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) অনুমোদন এবং তাদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় গাজীপুর সাফারি পার্কের অভ্যন্তরে করা সম্ভব হয়েছিল।
সত্যি বলতে একেবারে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা অভয়ারণ্যে গিয়ে বন্যপ্রাণীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা দুরূহ ব্যাপারই বটে। তাই বিকল্প হিসেবে সাফারি পার্ককেই আমি এ কাজের জন্য বেঁছে নিয়েছিলাম, যেখানে প্রাকৃতিক বন-জঙ্গল পাওয়া না গেলেও কৃত্রিমভাবে তৈরি প্রাণীকুলের স্বভাবসিদ্ধ প্রকৃতিরাজ্য গড়ে উঠেছে।
তবে আজকে শুধুমাত্র বেঙ্গল টাইগারকে নিয়ে আমার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করব।
সময়টা তখন মধ্য দুপুর। গাড়িতে বসে আশপাশের ঝোপঝাড় আর নালাগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখতে চেষ্টা করছি! মিনিট দশেক পরেই দেখলাম একটা মোটা গাছকে টার্গেট করে লেজ অনেকটা উপরের দিকে তুলে একধরনের তরল পদার্থ ছিটিয়ে
দিচ্ছে একটি বাঘ! কিছুক্ষণ পরপরই এই কাজটি করে যাচ্ছে সে, নিয়মিত বিরতিতে! চোখে বাইনোকুলার গুঁজে গভীরভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। স্বভাবতই বাঘ ‘টেরিটোরিয়াল’ প্রাণী! এরকম তরল পদার্থ ছিটিয়ে তারা তাদের টেরিটোরি বা এলাকা চিহ্নিত করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই তরলের গন্ধটা অনেকটা বাটার মাখানো পপকর্নের মতো! এটিকে বলা হয় ‘মার্কিং ফ্লুইড’।
সাধারণত খাদ্যের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে টেরিটোরি ছোট-বড় হয়ে থাকে। বাঘ এবং বাঘিনী উভয়ই তাদের নির্ধারিত এলাকায় টহল দিয়ে বেড়ায়। ছোট এলাকা হলে দু’য়েক দিন পরপর একটি নির্দিষ্ট স্থানে তাদের উপস্থিতির পরিচয় পাওয়া যাবে গাছের গুঁড়িতে আঁচড়ের মাধ্যমে অথবা মল-মূত্রের চিহ্ন দেখে। অর্থাৎ গাছের গুঁড়িতে নখের আঁচড় কেটেও বাঘরা তাদের সীমানা নির্ধারণ করতে পারে!
আমাদের গাইড রনি ভাই আমাদেরকে এরকমই কিছু গাছের সন্ধান দিলেন। গাছগুলোতে আমরা অসংখ্য আঁচড়ের সুস্পষ্ট দাগ দেখতে পেলাম! সত্যি বলতে গাছের এই ক্ষতবিক্ষত চেহারা দেখে বেশ খারাপই লাগছিল! কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ এইনিয়মকে মেনে তো নিতেই হবে।

এখানে অবশ্য একটি বিস্ময়কর রহস্যও লুকিয়ে রয়েছে! গবেষণায় দেখা গেছে,যখন কোনো বাঘ তার টেরিটোরি বা এলাকা চিহ্নিত করতে কোনো গাছের গুঁড়িতে আঁচড় কাটে, তখন সে চেষ্টা করে সবচেয়ে উঁচুতে তার নখের আঁচড়টিকে রাখতে! কারণ এটি দেখে অন্য কোনো বাঘ যেন সহজেই বুঝতে পারে ইতোমধ্যে এই এলাকাটি কারো না কারো দখলে রয়েছে! অতঃপর কোনো বাঘ যদি সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তার চেয়েও উঁচুতে নিজের নখের আঁচড় কাটতে পারে, তাহলে এলাকাটি খুব সহজেই সে তার নিজের দখলে নিয়ে নিতে পারবে! কারণ আগের বাঘটি তখন তার নিজের চেয়ে অপর বাঘটিকে বেশি শক্তিশালী মনে করে তার সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধ এড়াতে চেষ্টা করে!
উল্লেখ্য, তাদের আঙুলের ফাঁকে ইন্টারডিজিটাল গ্ল্যান্ড আছে! এই গ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত করে বাঘটি রেখে যেতে পারে তার নিজস্ব ‘গন্ধবার্তা’!

যাহোক, অনেকটা সময় এভাবেই কেটে গেল। এতক্ষণ সোজা পথেই আমাদের গাড়িটা চলছিল, এবার একটা বাঁক ধরে বেশ কিছুদূর যেতেই অসাধারণ এক দৃশ্য আমাদের চোখে ধরা পড়ল! দৃশ্যটা আরো ভালো করে দেখার জন্য গাড়িটাকে আমরা
একদম কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। এরপর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম আর বিরল এই দৃশ্যটিকে ক্যামেরাবন্দি করতে পারার আনন্দে ‘মহারাজাকে’ মনে মনে বারবার ‘ধন্যবাদ’ জানাতে থাকলাম!
আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ঠিক যেন গরু-ছাগলের মতো করে বেঙ্গল টাইগার অর্থাৎ আমাদের ‘রাজামশাই’ ঘাস খাচ্ছেন, অনেকটা আয়েশ করে! সত্যি বলতে, মোটেও শখের বশে নয় বরঞ্চ বিপদে পড়লেই কেবলমাত্র মাংসাশী এই প্রাণীটিকে কিছু সময়ের জন্য তৃণভোজী হয়ে উঠতে হয় অর্থাৎ ঘাস খেতে হয়! মূলত অনেক সময় মাংস খাওয়ার পর অম্লের কারণে তাদের হজমে সমস্যা হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পরিপাকতন্ত্রে কোনো ধরনের গোলযোগ দেখা দিলে সাধারণত তারা এমনটি করে থাকে! এছাড়া খাবার পাওয়া না গেলে অথবা হজম শিথিল করার প্রয়োজন দেখা দিলে বাঘকে মাঝে মাঝে ঘাস, বেরি ও বিভিন্ন ধরনের ফল খেতে হয়!
এদিকে, বেশ দীর্ঘক্ষণ ধরেই চলল তার এই ঘাস খাওয়ার কার্যক্রম! এরপর ধীরে ধীরে খুব কৌশলে সন্তর্পণে দুর্গম ঘাস-বনের ভেতরে গা ঢাকা দিলো ‘মহারাজা’!
এসব বিষয় ছাড়াও আরো অনেকগুলো বিস্ময়কর ঘটনাবলীর সাক্ষী হতে পেরেছিলাম আমরা। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে একে একে সেগুলোকে আমরা ক্যামেরাবন্দি করতেও সক্ষম হয়েছি!
লেখক- এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।