বদলে গেছে পরিস্থিতি

ভূমধ্যসাগরীয় দাবানল কোনো দুর্ঘটনা নয়

এবারের গ্রীষ্মের ভয়াবহ দাবানল দেখিয়ে দিল জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমির অবহেলা ও দুর্যোগভিত্তিক পুঁজিবাদ কিভাবে বনকে জ্বালানিতে পরিণত করছে।

মেহেদী হাসান
স্পেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গারানোতে দাবানল মোকাবেলায় স্পেনের সামরিক জরুরি ইউনিটের একজন সদস্য
স্পেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গারানোতে দাবানল মোকাবেলায় স্পেনের সামরিক জরুরি ইউনিটের একজন সদস্য |সংগৃহীত

তুরস্ক থেকে গ্রিস, ফ্রান্স থেকে স্পেন- এবারের ভূমধ্যসাগরীয় দাবানল একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে যে, পরিস্থিতি বদলে গেছে। এ দাবানলের কারণ মাঝেমধ্যে ঘটে যাওয়া খরা বা অস্বাভাবিক মৌসুম নয়। কথিত ষষ্ঠ প্রজন্মের এ দাবানলকে উসকে দিচ্ছে জলবায়ু ও সামাজিক যুক্তি। যা বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ-পুঁজিবাদের যন্ত্রে গভীরভাবে প্রোথিত।

পরিস্থিতি ভয়াবহ। ২৬ আগস্ট ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে এক মিলিয়নেরও বেশি হেক্টর (৩ হাজার ৮৬০ বর্গমাইল) জমি পুড়ে গেছে। এটি গত ২০ বছরের গড়ের চার গুণ বেশি।

স্পেনে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি ৪০ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে চার লাখ ১৬ হাজার হেক্টরে (১৫৫ থেকে ১ হাজার ৬০৬ বর্গমাইল) পৌঁছায়। ফলে ২০২৫ শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বনভূমি ধ্বংস হওয়া বছর হয়ে দাঁড়ায়। একইসাথে আগুনজনিত নির্গমন ২০০৩ সাল থেকে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়।

এ দাবানল লাখের অধিক মানুষকে পালাতে বাধ্য করেছে। এ ছাড়াও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে দমকলকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরাও ছিলেন। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, যেমন মাদ্রিদ ও গালিসিয়া রেললাইন ভেঙে পড়েছে।

শুধু আগুন নয়, প্রচণ্ড তাপও ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। ২২ আগস্ট পর্যন্ত স্পেনের জাতীয় গবেষণা কাউন্সিলের এমএসিই সিস্টেম হিসেব করেছে, গ্রীষ্মে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ তাপে মারা গেছে। যা মাত্র দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় ছয় হাজার বেশি।

এই দাবানলগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন বা প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। এ বিপর্যয় আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গতি পেয়েছে। আর ভূমি-ব্যবহার নীতিমালা মুনাফা ও প্রবৃদ্ধির স্বার্থ এটিকে আরো তীব্র করেছে।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও যত্নকে অগ্রাধিকার না দিয়ে গত ১৩ বছরে বহু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে দিয়েছে। এর সাথে গ্রামীণ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী অবহেলা এবং করপোরেট ও আর্থিক স্বার্থনির্ভর ভূমি-ব্যবহারের মডেল যুক্ত হয়েছে। যেখানে দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকার বদলে পর্যটন খাতের স্বল্পমেয়াদী লাভকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

পুঁজির প্রসারমান জড়তা সবকিছুকে পণ্যে রূপান্তরিত করেছে। যত্ন ও প্রতিরোধকে মুনাফার অধীনস্থ করে ভূখণ্ডের দৃশ্যকে আমূল বদলে দিয়েছে।

এছাড়াও এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিবেশের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। শিকারি ও কৃষি-শিল্পের স্বার্থে স্থানীয় কৃষিকে দুর্বল করেছে। আর বিশাল অঞ্চলকে একমুখী চাষাবাদ, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও বসবাসের অযোগ্য স্থানে রূপান্তর করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে দাবানল আর দুর্ঘটনা নয়। এগুলো হয়ে উঠেছে সামাজিক ব্যবস্থার বিশ্বস্ত বাহক, যা স্বয়ংক্রিয় সত্তা হিসেবে অপ্রতিরোধ্য, নির্দয়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আর শ্রম ও জীবনকেই চরম সীমায় ঠেলে দিচ্ছে।

এর প্রভাব আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বৈষম্যকে প্রকাশ করে। শ্রমিক, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, অভিবাসী ও জনশূন্য অঞ্চলের মানুষই আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ ও ভৌগোলিক বিভাজনের কারণে এ ঝুঁকি আরো বাড়ে। ফলে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভূমধ্যসাগরের অনেক অঞ্চলে আগুন আরো দ্রুত, অপ্রত্যাশিত ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। একটি নতুন জলবায়ুগত স্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে, যেখানে তাপ ও খরা মিলিত হয়ে ঝুঁকি বাড়ছে। বনভূমির অভিযোজন ক্ষমতা শেষ হয়ে রূপ নিচ্ছে সময় বোমায়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে বায়োমাস জমছে, একমুখী কৃষি আর গ্রামীণ অবহেলায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে জনসমাজে বিভ্রান্তিকর আলোচনা চলছে। কয়েক সপ্তাহ আগে কাতালোনিয়ার প্রেসিডেন্ট সালভাদর ইল্লা ঘোষণা দেন, এখানে খুব বেশি বন আছে। অথচ ভূমধ্যসাগরের মতো অঞ্চলে সমুদ্র নিজেই ফুটছে এবং দাবানল, খরা ও আকস্মিক বন্যার মতো চরম ঘটনা বাড়ছে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জঙ্গলের পরিমাণ কমানো। যদিও বন বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা কার্বন শোষণ করে, নিম্ন অ্যালবেডোর মাধ্যমে চারপাশকে ঠাণ্ডা রাখে এবং উচ্চ পরিবেশগত বহুমুখিতা দ্বারা পরিবেশকে স্থিতিশীল রাখে।

আগামী দিনের পথ হলো বনের সাথে অভিযোজনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা। এমন এক ধরনের ব্যবস্থাপনা করা, যেখানে জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও উন্নয়ন করবে, মাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে জমে থাকা বায়োমাস কমাবে। সর্বোপরি, জনগোষ্ঠী ও ভূখণ্ডের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করবে।

এটি শহর-গ্রাম বিভাজন কমানোর জন্য অপরিহার্য। যেখানে গ্রামকে দেখা হয় কেবলমাত্র পণ্য সরবরাহকারী ও নগর বর্জ্য ফেলার জায়গা হিসেবে। এর জন্য প্রয়োজন হলো পরিবেশ-সামাজিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ, যা স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গিকে ছাড়িয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে পরিচালিত করবে।

তবুও, এই প্রাতিষ্ঠানিক দহনের মাঝেও প্রতিরোধ বাড়ছে। যারা অ্যাগ্রোইকোলজি (পরিবেশগত নীতি ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে টেকসই কৃষি) অনুশীলন করছে, যারা উপনিবেশিক শোষণ থেকে আমাজন থেকে প্যালেস্টাইন পর্যন্ত ভূখণ্ড রক্ষা করছে এবং যারা জলবায়ু ন্যায়ের আন্দোলন চালাচ্ছে, তারা দেখিয়ে দিচ্ছে ভিন্নভাবেও বাঁচা সম্ভব।

এসব অভিজ্ঞতা দেখায় যে, বন যেমন জ্বলছে, তেমনি জ্বলছে সেই শৃঙ্খল, যা এগুলোকে প্রজ্বলিত করেছে। তারা দাবি করে এমন নীতিমালা, যা বিভাজন ও বৈষম্যের মোকাবিলা করবে। প্রশমন ও অভিযোজনের বাইরেও জীবনকেই কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনবে ও সম্মিলিত মুক্তির অঙ্গীকার করবে।

কারণ যতদিন সঞ্চয়, শোষণ ও বঞ্চনা আমাদের সামাজিক ও পরিবেশগত সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করবে, ততদিন গ্রীষ্মকালীন দাবানল আরো আগে ও আরো ভয়াবহভাবে ঘটতে থাকবে।

দাবানল এগোচ্ছে সেই ব্যবস্থার সাথেই, যা এগুলোকে জ্বালানি যোগাচ্ছে। আমরা যদি না চাই এটি আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা হয়ে উঠুক, তবে আমাদের জীবনের কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে এমন আলো যা যত্ন, অর্থবোধ ও ভবিষ্যতের পথের দিশা দেখায়। পরিবেশগত ও সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া দুর্যোগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধক সম্ভব নয়।

আলজাজিরা অবলম্বনে।