গভীর সমুদ্রের উষ্ণ জলধারায় অক্টোপাস মায়েদের ডিম ফোটানোর রহস্য

আমি সবসময় গভীর সমুদ্রকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। এটি আসলেই আমাদের পৃথিবীর সত্যিকার অর্থে অনাবিষ্কৃত অংশ। আমি প্রায়ই গভীর সমুদ্র অভিযানের সরাসরি ভিডিও দেখি। এমনই এক অভিযানের ভিডিওতে প্রথমবার আমি গভীর সী-মাউন্টে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখি।

মেহেদী হাসান
গভীর সমুদ্রে অবিশ্বাস্য প্রাণীদের ঘনিষ্ঠ ছবি তোলা হচ্ছে
গভীর সমুদ্রে অবিশ্বাস্য প্রাণীদের ঘনিষ্ঠ ছবি তোলা হচ্ছে |বিবিসি আর্থ

প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে এক নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরির ঢালে হাজার হাজার স্ত্রী অক্টোপাস ডিমে তা দিচ্ছে, এমন এক বিরল দৃশ্য ধরা পড়েছে বিবিসির জনপ্রিয় ধারাবাহিক প্ল্যানেট আর্থ III এর ক্যামেরায়।

একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রযোজক ও পরিচালক উইল রিজন ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে প্ল্যানেট আর্থ III পর্দায় রহস্যময় গভীর সমুদ্রে অক্টোপাসের প্রজনন ক্ষেত্র তুলে ধরেছে।

আমি সবসময় গভীর সমুদ্রকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। এটি আসলেই আমাদের পৃথিবীর সত্যিকার অর্থে অনাবিষ্কৃত অংশ।

আমি প্রায়ই গভীর সমুদ্র অভিযানের সরাসরি ভিডিও দেখি। এমনই এক অভিযানের ভিডিওতে প্রথমবার আমি গভীর সী-মাউন্টে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখি।

রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকল (আরওভি) এর আলোতে দেখা গেল সারি সারি উল্টে শুয়ে থাকা প্রায় ২০ হাজার স্ত্রী অক্টোপাস ডিমে তা দিচ্ছে। গভীর সমুদ্রে সাধারণত অক্টোপাসকে একাকী প্রাণী হিসেবে ধরা হলেও এখানে তারা দলবদ্ধ হয়ে অবস্থান করছে।

Octopas

আমরা সাথে সাথে এ বিরল দৃশ্য প্ল্যানেট আর্থ III এ অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক অক্টোপাস এখানে কেনো অবস্থান করছে তা জানার জন্য আরো তথ্য প্রয়োজন ছিল।

সৌভাগ্যবশত, সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (এমবিএআরআই) এ বিষয়ে আরো জানার জন্য একটি প্রকল্প শুরু করে। পরিবেশবিদ জিম ব্যারির নেতৃত্বে গভীর সমুদ্রের এই গবেষণা আমাদের জন্য এক অসাধারণ সুযোগ তৈরি করেছিল। আমরা এ অসাধারণ জায়গায় অনেক সময় ধরে ভিডিও ধারণ করার সুযোগ পাই। প্রয়োজনীয় ফুটেজ সংগ্রহ করতে প্রায় দুই বছরের মধ্যে একাধিকবার সপ্তাহব্যাপী অভিযানে যেতে হয়েছিল।

কয়েক মাস পরিকল্পনার পর, আমি প্রথমবার অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখনই কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হলো। এ অভিযানে জাহাজটি অল্পসংখ্যক ক্রূ নিয়ে যাত্রা করল। আমাকে ব্রিস্টলের বাসায় বসে প্রায় পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে শুটিং পরিচালনা করতে হয়েছিল।

দূর থেকে দলের সাথে কাজ করছিলাম। এতে অক্টোপাসের দৃশ্য দেখা বেশ অদ্ভুত লাগছিল। ফুটেজ উৎসাহজনক ছিল, কিন্তু বুঝতে পারলাম এখনো অনেক কাজ বাকি।

Octopas-05

এমবিএআরআই এর সঙ্গে কাজ করে আমরা একটি ক্যামেরা তৈরি করলাম। এ ক্যামেরা আরওভি এর দুটি রোবটিক বাহুকে ব্যবহার করে ডিমে তা দেওয়া অক্টোপাস মায়েদের মধ্যে একটি ছোট রিমোট ক্যামেরা স্থাপন করতে পারে। এই অনন্য সেটআপ আমাদেরকে এই বিস্ময়কর প্রাণীদের সবচেয়ে কাছাকাছি দৃশ্য ধারণ করার সুযোগ দিয়েছে।

দ্বিতীয়বার অভিযানের সময় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হয়। তাই আমি সরাসরি দলের সাথে যোগ দিলাম।

আরওভি (ডক রিকেটস নামে পরিচিত) একটি ট্রাকের সমান বড়। এটিকে জাহাজের মুন পুল (জেমস বন্ড ধাঁচের ফাঁদ-দরজা, এটি জাহাজের তলায় থাকে) দিয়ে নিচে নামাতে হয়। ৯০ মিনিট নিচে যাওয়ার পর আরওভি সাগরের তলায় পৌঁছায়। আমি প্রথমবারের মতো এই বিস্ময়কর স্থানে ভিডিও ধারণ করার সুযোগ পাই।

Octopas-02

জাহাজের কন্ট্রোল রুম থেকে পাইলটরা যন্ত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা ডিমে তা দেওয়া মায়েদের চারপাশে যন্ত্রটি ঘুরিয়ে নেয়। এরপর রোবটিক বাহু দিয়ে ক্যামেরাকে ঠিক জায়গায় স্থাপন করে। তখন আমি প্লে-স্টেশন কন্ট্রোলার দিয়ে ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম।

প্রযোজক উইল রিজন বলেন, এমন কাছাকাছি ও অন্তরঙ্গ দৃশ্য আমাদেরকে এই নিবেদিতপ্রাণ মায়েদের সংগ্রামের ব্যাপারে আরো গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে।

গভীর সমুদ্রে শুটিং করতে প্রচুর সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। কারণ সমুদ্রতলে অন্ধকার, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও ভয়ানক চাপ (সমুদ্রপৃষ্ঠের চাপের ৩০০ গুণ) থাকে। এমনকি সাধারণ কাজ করতেও অনেক সময় লেগে যায়।

পাইলটরা আরওভি এর রোবটিক বাহু দুই মাইল ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য ধারণে এমন পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।

এক পর্যায়ে, এক অক্টোপাস মা সামান্য নড়াচড়া করলে দেখা যায় তার অমূল্য ডিম। আমরা ভেতরের বিকাশমান ভ্রূণ দেখতে পেলাম। এমন দৃশ্য আমাদেরকে দেখালো, এই নিবেদিতপ্রাণ মায়েরা কীভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করে সন্তানদের রক্ষা ও লালন করে। এ আবেগময় বিষয়টি তাদের সংগ্রাম আরো গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

Octopas-04

তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল জিম ও তার দলের দুই বছরের গবেষণায় পাওয়া আবিষ্কারগুলো। জিম বলেন, এই অক্টোপাস মায়েদের নিয়ে গবেষণা ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে, আমি তাদের সংগ্রামকে বুঝতে শুরু করেছি। যেভাবে তারা নিজের জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও সন্তানদের রক্ষা করে। আমার কাছে তারা হয়ে উঠেছে আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব ও বন্ধু।

ভিডিও শেষ করার পর, জিম তার যুগান্তকারী গবেষণাপত্রে কয়েকটি বিষয় তুলে আনেন। এ গবেষণায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয় কীভাবে এই ‘অক্টো-মা’রা নিষ্ক্রিয় গভীর সমুদ্রে আগ্নেয়গিরির চারপাশে জড়ো হয়। তারা সাগরের তলার ফাটল থেকে বের হওয়া উষ্ণ পানি ব্যবহার করে ডিম ফোটায়। গভীর সমুদ্রের হিমশীতল পানিতে অক্টোপাসের ডিম ফুটতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। কিন্তু এই উষ্ণ জলধারার প্রভাবে সময় কমে এসেছে মাত্র দুই বছরে। এ সময়ে মায়েরা ডিম ছেড়ে খাবার খেতেও যায় না।

জিম ও তার এমবিএআরআই দলের জন্যই আমরা এ অবিশ্বাস্য স্থান সম্পর্কে জানি। প্রথমবারের মতো আমরা বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশগুলোর একটিতে এই ‘অক্টো-মা’দের জীবন দেখতে সক্ষম হয়েছি।

মূল প্রবন্ধ : উইল রিজন।