সাগরে মাছের বংশবৃদ্ধি, টেকসই আহরণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৫ এপ্রিল থেকে আগামী ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর সমুদ্র জলসীমায় চলছে মাছ শিকারের হিরিক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাছ ধরার এমন খবরের সত্যতা যাচাইয়ে রাঙ্গাবালীর উপজেলার সবচেয়ে বড় মৎস্য ঘাট খ্যাত চরমোন্তাজ স্লুইচ ঘাটে গেলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে শত শত ট্রলার ঘাটে থাকার কথা থাকলেও অনেক কম ট্রলার বাঁধা রয়েছে ঘাটে। সাধারণত মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞায় জেলেরা ছেড়া জাল সেলাইয়ে বা মেরামতে অলস সময় পার করেন। এবার সে দৃশ্যও অনুপস্থিত। আর যেসব ট্রলার ঘাটে অবস্থান করছে সেসব ট্রলারের মধ্যে কোনো কোনো ট্রলারের জেলেদের নানা তৎপরতা চোখে পড়ে। বরফ তোলা হচ্ছে কোন ট্রলারে, কোনো ট্রলারে তোলা হচ্ছে জাল, আবার কোনো কোনো ট্রলারে ডিজেল এবং এলপিজি সিলিন্ডার তোলা হচ্ছে জ্বালানি হিসেবে। রসদ-সামগ্রী বোঝাই করে এসব ট্রলার ছুটে চলে সমুদ্রের পানে।
চরমোন্তাজ ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আনোয়ার মৃধার মালিকানাধীন ট্রলারের মাঝি চাঁন মিয়ার সঙ্গে কথা বলা হয় সমুদ্রে যাওয়ার এমন প্রস্তুতিকালে। তিনি বলেন, ‘আজ বিকেল কিংবা কাল সকালে সাগরে যাবো। মাছ হলে ৪-৫ দিন থাকবো। আর না হলে ৮-১০ দিন।’ গন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, ‘সোনারচরের পূর্বদিকে (বঙ্গোপসাগর)। একেক ট্রিপে ২০-৩০ মণ মাছ পাই।’
এ সময় সমুদ্রগামী জেলে মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘সাগরে এখন ম্যালা (প্রচুর) বোট আছে। টাইগার চিংড়ি, তুলার ডাডি, সাদা চিংড়ি, তাপসী (রামসোস), পোমাসহ বিভিন্ন মাছ ধরে। কাঁকড়াও ধরে অনেকে। নেটওয়ার্কের বাহিরে গভীর সাগরে গিয়ে মাছ ধরে। সেখানে প্রশাসনের লোকজন যেতে পারে না।'
মাঝি চাঁন মিয়া ও ইব্রাহিম কথা শেষ করেই মাঝি-মাল্লাসহ ট্রলার নিয়ে সাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শুধু তারা নয়, ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখা যায় এ রকম অসংখ্য ট্রলার যাচ্ছে, আবার মাছ ধরে কিছু ট্রলার ঘাটে ফিরেও আসছে।
এবার সরেজমিনে সমুদ্রে মাছ শিকারের চিত্রের সত্যতা যাচাইয়ে একটি ট্রলার নিয়ে চরমোন্তাজ মৎস্য ঘাট থেকে প্রতিবেদক রওনা দেন সাগরের দিকে। বুড়াগৌরাঙ্গ নদী চলতে চলতে চোখে পড়ে অসংখ্য জেলে ট্রলার। কোনোটি ঘাট থেকে ছেড়ে যাচ্ছে সাগরের উদ্দেশ্যে, আবার কোনোটি মাছ ধরে ফিরছে। নদীপথে প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর ট্রলার পৌঁছে চরহেয়ার সংলগ্ন সাগর মোহনায়। সেখান থেকে একঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে উত্তাল সাগরের ঢেউ পেরিয়ে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে।
বঙ্গোপসাগরে ঢুকতেই চোখে পড়ে অসংখ্য ট্রলারে চলছে মাছ ধরার মহোৎসব। জেলেরা সামুদ্রিক নানা প্রজাতির মাছ ধরছেন লালজাল, বাঁধাজালসহ অন্যান্য জাল দিয়ে। নেই কোন টহল, নেই কোনো নিষেধাজ্ঞার ছাপ।
নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের এমন ভয়াবহতা চরমোন্তাজের চরহেয়ার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে দেখে এবার সরু খাল পেড়িয়ে সোনারচর সংলগ্ন সাগরে পৌঁছালে সেখানেও দেখামেলে একই চিত্র। উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিবেদকের ট্রলার বেশি দূর এগুতে না পারলেও যতদূর যাওয়া গেছে তাতেই পাওয়া গেছে খবরের সত্যতা।
জানা যায়, শিকার করা মাছ সাগরেই চলে বেচাকেনা। জেলেদের কাছ থেকে ক্যারিংবোট নিয়ে ব্যবসায়ীরা সাগরে গিয়ে মাছ কেনেন। সোনারচর ও চরহেয়ার সংলগ্ন সাগর মোহনায় গিয়ে দেখা যায় একের পর এক ফিশিং ট্রলার সাগর থেকে মাছ ধরে নিয়ে আসছে। সেখান থেকে ক্যারিংবোটে মাছ তুলে দেয়া হচ্ছে। ক্যারিংবোটে মাছ দিয়ে কেউ ট্রলার নিয়ে তীরে চলে যাচ্ছে আবার কেউ বাজার-সদাই করে ছুটে চলছে সমুদ্রে।
উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের বাইলাবুনিয়া ট্রলারের জেলে দুলাল বলেন, ‘বৃষ্টি-বর্ষার সময় নৌপুলিশ তেমন নামে না। যখন সাগর শান্ত থাকে, তখন নৌপুলিশ বোট বা স্পিডবোট নিয়ে সাগরে যায়। আমাদেরকে ধরতে পারলে জরিমানা করে।’ অনেকে না বলতে চাইলেও কিছু ট্রলারের মালিক, মাঝি ও জেলেরা ঘুষ দিয়ে সাগরে গিয়ে মাছ ধরার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, ‘সব ম্যানেজ করেই তারা সাগরে যান। ট্রলার মালিক ও মৎস্য আড়তদাররা এই ম্যানেজ করেন।
মায়ের দোয়া ট্রলারের জেলে শাকিল সিকদার বলেন, ‘ম্যানেজ করে যাইতে হয়। আমরা নিয়মিত মাছ ধরতেছি। অবরোধ দিছে, অনেক দিন চলেও গেছে।’
চরমোন্তাজের জেলে জলিল হাওলাদার বলেন, ‘টাইগারের জোবা চলতেছে। এখন প্রচুর বোট আছে। সব সাগরে গেছে। গভীর সাগরে যায়। সেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।’
জেলেরা বলছেন নিয়ম মানলে পেট চলবে কেমনে? তাদের ভাষ্যমতে, নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া খাদ্য সহায়তা সব জেলে পায় না। খাদ্য সহায়তার তালিকায় যাদের নাম আছে, তারাও সময়মতো এই সহায়তা পায় না। এখনও চাল বিতরণ হয়নি। জেলেদের অভিযোগ, প্রকৃত জেলে নন তবুও অনেক স্বচ্ছল মানুষ এই সহায়তা পাচ্ছেন। তাই নিরুপায় হয়ে সংসারের খরচ চালাতে অনেক জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙ্গাবালী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ দিয়ে থাকলে সেটা ভিত্তিহীন। আমরা অনৈতিক কাজের সাথে কোনো প্রকার জড়িত নাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি জেলেদের সাথে বিভিন্ন সময় মিটিং করেছি। ৫৮ দিনের অবরোধ যাতে সকলে মেনে চলে এজন্য লিফলেটও বিতরণ করেছি। আমাদের নৌযান নিয়ে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে সমুদ্রে যেতে পারি না। নিয়মানুযায়ী মৎস্য অফিসার বা অন্য সংস্থা আমাদের নিয়ে যাবে, তখন আমরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে পারবো।’
উপজেলা সামুদ্রিক সৎস্য কর্মকর্তা এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘যারা সাগরে আইন অমান্য করে মাছ ধরতে যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক থেকে দুই বছরের জেল বা জরিমানা করা হবে। আমাদের মৎস্য অফিস থেকে এ ধরণের বার্তা দিয়ে আমরা মাইকিং করেছি এবং লিফলেট বিতরণ করেছি। এরপরও কেউ আইন অমান্য করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও একোয়াকালচার বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, 'এভাবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরলে সামুদ্রিক সম্পদ ভয়াবহভাবে হুমকির মুখে পড়বে। নিষেধাজ্ঞা সফল করতে হলে প্রথমে নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার সময় কিংবা মাছ নিয়ে ফেরার সময় কোনো কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন অবরোধে নদীতে পাহাড়া দিলেও সাগরে পাহাড়া দেওয়ার সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। এই সময়ের দায় কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশের। এভাবে চলতে থাকলে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন এবং প্রজনন সুরক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।’