জলবায়ু সংক্রান্ত ভুল তথ্যের ব্যাপক বিস্তার এই সঙ্কটকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ে রূপান্তরিত করছে বলে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে জলবায়ু বিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও বিলম্বিত হওয়ার পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি, ডানপন্থী রাজনীতিবিদ এবং কিছু জাতি রাষ্ট্রের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যকে দায়ী করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক তথ্য পরিবেশ প্যানেল (আইপিআই) ৩০০টি গবেষণা পদ্ধতিগতভাবে পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে গবেষকরা দেখেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অস্তিত্ব অস্বীকার এই সমস্যার সমাধান ও বিতর্কিত প্রমাণ করার কৌশলের একটি প্রচারণা হিসেবে দেখা যায়।
গবেষকরা উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন- স্পেনে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ব্যাপক ব্ল্যাকআউটের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে দায়ী করার প্রচার ছিল একটি বিভ্রান্তিকর প্রচারণা।
গবেষকরা বলছেন, অনলাইন বট ও ট্রলগুলো মিথ্যা তথ্যকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়। এ সকল কর্মকাণ্ড জলবায়ু সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য প্রচারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষজ্ঞরা আরো জানিয়েছেন, জলবায়ু পদক্ষেপ বিলম্বিত করার জন্য রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মচারী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলেঅকে ক্রমবর্ধমানভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। যাতে তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারেন বা বিলম্ব করেন।
গবেষণায় বলা হয়, জলবায়ু সংক্রান্ত ভুল তথ্য, প্রতিবেদনে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা উভয়ের জন্যই ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়।
মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত এলিসা মোর্গেরা গত বৃহস্পতিবার জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের ভুল তথ্য এবং পরিবেশ দূষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবার হতে যাওয়া কপ-৩০ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ব্রাজিল। এ শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু সংক্রান্ত ভুল তথ্য দমনের জন্য জাতিসঙ্ঘের একটি পৃথক উদ্যোগের বিষয়ে দেশগুলোকে একত্রিত করবে।
‘এটি একটি বড় সমস্যা,’ বলে উল্লেখ করেছেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্লাউস জেনসেন। ড. ক্লাউস আইপাই পর্যালোচনার সহ-নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমাদের কাছে সঠিক তথ্য না থাকে, তাহলে আমরা কিভাবে সঠিক কারণ এবং রাজনীতিবিদদের পক্ষে ভোট দেব? আর রাজনীতিবিদরাই বা কিভাবে স্পষ্ট প্রমাণকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে রূপান্তর করবেন?
ড. ক্লাউস জেনসেন আরো বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি মনে করি যে (খারাপ উদ্দেশ্যপুষ্ট পক্ষগুলো) এখনো খুব সক্রিয় এবং সম্ভবত বর্তমানে সবকিছুতে তাদেরই হাত রয়েছে।’
জেনসেন যোগ করেন, ‘কার্বন নিঃসরণ অর্ধেক কমানোর জন্য আমাদের কাছে প্রায় পাঁচ বছর সময় আছে। এছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সঠিক তথ্য ছাড়া আমরা এটা অর্জন করতে পারব না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘এক্ষেত্রে জলবায়ু সঙ্কট জলবায়ু বিপর্যয়ে রূপান্তরিত করা সম্ভব, যদি না আমরা জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভুলতা সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি।’
গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে মোর্গেরা বলেন যে- দেশগুলোর উচিত তথ্য ব্যবস্থাকে ‘ডিফসিলাইজ’ করা। অর্থাৎ শক্তিশালী জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শিল্পের দশকব্যাপী ভুল তথ্য ছড়ানোর সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করা।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রগুলোর উচিত ‘জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের ভুল তথ্য এবং ভুল উপস্থাপনায় (গ্রিনওয়াশিং) কে অপরাধী ঘোষণা করা’। একইসাথে ‘জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর দ্বারা ভুল তথ্য এবং ভুল তথ্য প্রচারের জন্য মিডিয়া ও বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোকে অপরাধী ঘোষণা করা’।
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ২০২৪ সালের জুন মাসে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ সময় তিনি এই সংস্থাগুলোকে ‘জলবায়ু বিশৃঙ্খলার গডফাদার’ বলে অভিহিত করেন।
জাতিসঙ্ঘ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা বজায় রাখতে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
জার্মানির বনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জলবায়ু আলোচনায় ব্রাজিল বিশ্বের দেশগুলোকে জলবায়ু মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পদক্ষেপ জোরদার করার আহ্বান জানাবে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চিলি, মরক্কো এবং অন্যান্য দেশগুলো ইতোমধ্যেই এই উদ্যোগে স্বাক্ষর করেছে।
ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে আজোলে বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।’
আইপিআই রিপোর্টটি জলবায়ু সংক্রান্ত ভুল তথ্য কারা তৈরি করছে, কিভাবে তারা তা প্রচার করছে, এর প্রভাব কী এবং কিভাবে এটি মোকাবেলা করা যেতে পারে তার একটি বিস্তৃত মূল্যায়ন।
এ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ হলো- ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য জলবায়ু বিজ্ঞান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপর জনসাধারণের আস্থা হ্রাস করেছে। তথ্যের অখণ্ডতার এই ঘটনা জলবায়ু সঙ্কটকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুল তথ্যের মধ্যে রয়েছে- শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জীবাশ্ম গ্যাসকে ‘কম-কার্বন জ্বালানি’ হিসেবে প্রচার করছে। এমনকি এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্র তত্ত্বও রয়েছে। যেমন এই বছর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলকে শিশু পাচারকারী টানেল ধ্বংস করার জন্য কর্মকর্তারা পরিকল্পনা করেছিলেন বলে প্রচার।
অনুসন্ধানের মধ্যে রয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প জনসাধারণের সাথে ‘দ্বৈত প্রতারণা’ করেছে, প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা অস্বীকার করা, এর দায়িত্বকে আড়াল করা এবং জলবায়ু কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়া। দ্বিতীয়ত, পরিবেশগতভাবে টেকসই উদ্যোগ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গ্রিনওয়াশ স্থাপন করা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে- অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোও জলবায়ু সংক্রান্ত ভুল তথ্য প্রচার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- মার্কিন বিদ্যুৎ কোম্পানি, পশু পালন, বিমান সংস্থা, পর্যটন ও ফাস্ট ফুড।
জলবায়ু বিজ্ঞানকে ‘একটি বিশাল প্রতারণা’ এবং ‘বাজে কথা’ বলে অভিহিত করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন প্রধান প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ট্রাম্পের ‘যৌক্তিক ভুল ও ভিত্তিহীন দাবি ব্যাপকভাবে’ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের দ্বারা পুনঃপোস্ট করা হয়েছিল। এর মধ্যে অনেক বট অ্যাকাউন্টও রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে- রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ট্রল ফার্ম ব্যবহার করেছে।
তবে, জেনসেন বলেন যে সমস্যাটি সামাজিক মাধ্যমের চেয়েও গভীর। ‘শিল্প ও রক্ষণশীল থিঙ্কট্যাঙ্কের জোটগুলো আসলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপর ভুল তথ্যের লক্ষ্যবস্তু করে। এই লিঙ্কগুলো বিশেষভাবে উদ্বেগজনক কারণ এটি একটি ষড়যন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’
ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে, ডানপন্থী জনতাবাদী দলগুলো ‘জলবায়ু বিজ্ঞানকে সক্রিয়ভাবে লঙ্ঘন করছে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জার্মানির এএফডি, স্পেনের ভক্স ও ফ্রান্সের জাতীয় সমাবেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রক্ষণশীল বা ডানপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের অধিকারী মিডিয়া আউটলেটগুলো জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত অস্বীকার, সংশয় ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোকে অগ্রাধিকার দেয় এবং প্রসারিত করে।
জলবায়ু সংক্রান্ত ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর কন্টেন্টের মিত্যাচার বাড়ানোর জন্য নিয়ন্ত্রণ। যেমনটি ইইউ ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে তাদের নির্গমনের মানসম্মত ঘোষণা করতে বাধ্য করা।
জেনসেন বলেন, জলবায়ু সংক্রান্ত ভুল তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কিছু আইনি মামলা ইতোমধ্যেই চলছে। দীর্ঘমেয়াদে, উন্নত জলবায়ু শিক্ষা নাগরিকদের ভুল তথ্য শনাক্ত করতে সক্ষম করবে।
জেনসেন আরো বলেন, এ বিষয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন কারণ এখন পর্যন্ত গবেষণাগুলো মূলত ইংরেজি ভাষার ভুল তথ্য এবং পশ্চিমা দেশগুলোর উপর করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- ৩০০টি গবেষণার মধ্যে মাত্র একটি আফ্রিকার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে।
সূত্র : দ্যা গার্ডিয়ান