কাওসার আজম ব্রাজিল থেকে
জাতিসঙ্ঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০-এর পঞ্চম দিনটি জ্বালানি, শিল্প, পরিবহন, অর্থায়ন, কার্বন বাজার ও নন-সিও₂ গ্যাসকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে। শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) টেকসই জ্বালানি উত্তরণ, সবুজ শিল্পায়ন ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে ভেন্যু জুড়ে ব্যস্ত সময় কাটান রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, ব্যবসায়িক নেতা, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ। তবে, সকালে নিরাপত্তাবেষ্টিত ব্লু জোনের প্রধান ফটক কিছু সময়ের জন্য বিক্ষোভের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। পরে তা খুলে দেয়া হলে নিরাপত্তা যাচাই অপেক্ষার লাইন দীর্ঘ হয়।
প্রতিবছরের মতো গত ১০ নভেম্বর ব্রাজিলের পারা প্রদেশের আমাজন বনের পাদদেশে বেলেম শহরে বসেছে জলবায়ু সম্মেলন (কপ৩০)। আগামী ২১ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। তবে, এই জলবায়ু সম্মেলন ক্রমেই বিশ্ববাসীর জন্য শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিচ্ছে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত বাস্তবতায় এই সম্মেলনগুলোর গুরুত্ব থাকলেও প্রভাবশালী দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জাতীয় স্বার্থের কারণে এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ব্রাজিলের বেলেমে চলমান জাতিসঙ্ঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০–এ এবারো করপোরেট প্রভাব ও জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের উপস্থিতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ফোরামে এ বছর রেকর্ডসংখ্যক ১ হাজার ৬০০’রও বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি খাতের লবিস্ট প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। আয়োজক দেশ ব্রাজিল ব্যতীত অন্য যেকোনো দেশের সরকারি প্রতিনিধিদলের তুলনায় এই সংখ্যা অনেক বেশি। জলবায়ু ন্যায্যতা জোট ‘কিক বিগ পলিউটার্স আউট’ জানিয়েছে, কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রতি ২৫ জনে একজন জীবাশ্ম জ্বালানি খাতের প্রতিনিধি—গতবারের তুলনায় যা ১২ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০২১ সালে লবিস্ট–সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ শুরুর পর এটাই সর্বোচ্চ অনুপাত।
গত পাঁচ বছরে কপ সম্মেলনগুলোর মোট লবিস্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ হাজার। ফলে করপোরেট দখল, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং তেল–গ্যাস কোম্পানির বিপুল মুনাফার প্রেক্ষাপটে আলোচনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তীব্র হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন কেন্দ্র–সিআইইএলের সিনিয়র অ্যাডভোকেট লিয়েন ভ্যান্ডামে বলেন, ‘এটা আর জলবায়ু শাসন নয়, বরং করপোরেট দখলের ইঙ্গিত। কপ–এর নৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ কার্যকারিতাই এখন প্রশ্নের মুখে।’
এদিকে, কপ৩০–কে ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একদিকে ইইউ আলোচকরা অন্যান্য দেশকে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন, অন্যদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নিজেদের জলবায়ু লক্ষ্য শিথিল করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। নতুন প্রস্তাবে ২০৪০ সালের মধ্যে ১৯৯০ সালের তুলনায় ৯০% নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য রাখা হলেও ৫% বিদেশী কার্বন ক্রেডিট ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে—যা বিজ্ঞানসম্মত লক্ষ্য থেকে অনেক নিচে। একই দিনে ইইউ বন উজাড় রোধে সরবরাহ শৃঙ্খল আইন ও করপোরেট সবুজ নীতির কঠোরতাও কমিয়েছে। প্রতিযোগিতা বজায় রাখার যুক্তিতে গত দুই বছরে জোটটি একে একে বহু উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিবেশ নীতি ‘সরলীকরণ’ করে চলেছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বেলেমে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জলবায়ু আন্দোলনকারীরা জীবাশ্ম জ্বালানি ধাপে ধাপে বন্ধে বৈশ্বিক চুক্তির দাবিতে সরব হয়েছেন। ‘ফসিল ফুয়েল ট্রিটি’ উদ্যোগকে এখন পর্যন্ত ১৭টি দেশ সমর্থন দিয়েছে। জলবায়ু কর্মীদের মতে, কপ৩০–এর সভাপতিত্বকারী দেশ হিসেবে ব্রাজিলের উচিত কয়লা, তেল ও গ্যাসের যুগের ইতি টানতে দেশগুলোকে স্পষ্টভাবে উদ্বুদ্ধ করা। যদিও কপ২৮–এ ‘জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন’র প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, বাস্তবে অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর।
প্যারিস চুক্তির অন্যতম রূপকার ক্রিশ্চিয়ানা ফিগারেসের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বমঞ্চে ‘অবিশ্বাসযোগ্য’ অবস্থানে রয়েছে। কংগ্রেসের সিনিয়র ডেমোক্র্যাট ন্যান্সি পেলোসি বলেন, কপ৩০–এ যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি শুধু সরকারি অচলাবস্থার কারণে নয়; ব্রাজিলে দ্বিদলীয় প্রতিনিধি পাঠানো নিয়েও রিপাবলিকানদের অনীহা রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু কূটনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলেও আন্তর্জাতিকভাবে দূষণবিরোধী পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত করার ভূমিকা এখনো অব্যাহত রেখেছে। ফলে কপ আলোচনায় মার্কিন নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকট হচ্ছে।
এবারের সম্মেলনে ‘লিঙ্গ’ শব্দের সংজ্ঞা নিয়েও তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। নারী অধিকারকর্মী ও বহু দেশ মনে করছে, লিঙ্গ–বৈচিত্র্যের অন্তর্ভুক্ত ভাষা সংকুচিত হলে জলবায়ু নীতিতে নারীদের অভিজ্ঞতা, ঝুঁকি ও অংশগ্রহণ অদৃশ্য হয়ে যাবে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, সৌদি আরব, রাশিয়া ও ইরান ‘লিঙ্গ’ শব্দটিকে সীমিত অর্থে সংজ্ঞায়িত করতে জোর দিচ্ছে। ইইউ, নরওয়ে, কানাডাসহ বহু দেশ ইন্টারসেকশনালিটি–ভিত্তিক বিস্তৃত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংজ্ঞার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের ২৩ কোটি ৬০ লাখ নারী ও কন্যাশিশু খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে। বাস্তবতা বিবেচনায় লিঙ্গ–সংবেদনশীল নীতি গ্রহণ এখন জরুরি।
ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকারের সর্বশেষ মূল্যায়নে দেখা গেছে, কপ৩০–এর আগে মাত্র ১০০টি দেশ তাদের এনডিসি (জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান) হালনাগাদ করেছে। বর্তমান প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রায় ২.৬°সে পর্যন্ত বাড়তে পারে—যা প্যারিস চুক্তির ১.৫°সে লক্ষ্যমাত্রার বহু বাইরে।
গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্ট জানিয়েছে, ২০২৫ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন আরও ১% বাড়বে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দ্রুত প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তা বাড়তি জ্বালানি চাহিদা পূরণে এখনো যথেষ্ট নয়। পৃথিবী ইতোমধ্যে প্রাক–শিল্প যুগের চেয়ে ১.৩°সে উষ্ণ; এর ফলে ঝড়, দাবানল, খরা ও বন্যার মতো দুর্যোগ বাড়ছে।
কপ৩০–এ উদ্বোধন করা হয়েছে বিশ্বের প্রথম স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জলবায়ু অভিযোজন কাঠামো ‘বেলেম হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান’। এতে ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ, নীতি নির্ধারণ, সক্ষমতা উন্নয়ন এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সহজলভ্য অর্থায়নে জোর দেয়া হয়েছে।
ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ ফান্ডার্স কোলিশন প্রাথমিকভাবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু ভারতেই ২০৩০ সালের মধ্যে প্রয়োজন ৬৪৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য–অভিযোজন তহবিল এখনো যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের সাইড ইভেন্টে বক্তারা স্থানীয় নেতৃত্বাধীন প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের গুরুত্ব তুলে ধরেন। সুন্দরবন ও হাকালুকি হাওরের কার্যকর উদ্যোগ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কপ৩০–এর পাঁচ দিন পেরোতেই স্পষ্ট হয়েছে—বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনা এখনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, করপোরেট প্রভাব, লিঙ্গ–বিতর্ক ও নেতৃত্ব সংকটে জর্জরিত। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫°সে–এর মধ্যে রাখতে হলে এখনই প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, ন্যায়সঙ্গত অর্থায়ন, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি।
জবাবদিহিতা
সম্মেলনগুলো দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার একটি সুযোগ তৈরি করে।
যে কারণে আনুষ্ঠানিকতার অভিযোগ ওঠে— রাজনৈতিক বাধা : যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রায়শই উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দেয়। ট্রাম্প প্রশাসনের মতো উদাহরণগুলো এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা : সম্মেলনে অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও বাস্তবে দেশগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অগ্রগতি এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
অর্থায়নের ঘাটতি : দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তার জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থায়ন (যেমন, বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার) প্রায়শই পূরণ হয় না।
কপ৩০-এর পঞ্চম দিনের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে—
বিশ্ব জ্বালানি রূপান্তর, সবুজ শিল্পায়ন ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন নীতিগত অঙ্গীকারের স্তর পেরিয়ে বাস্তব বিনিয়োগ ও কার্যকর নীতিতে অগ্রসর হচ্ছে। উদ্ভাবন, অর্থায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বয়ই এ পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত করতে পারে—এ বার্তা দিয়েই দিন শেষ করছে বেলেমের কনফারেন্স ভেন্যু।



