ফেনীতে হঠাৎ বন্যা : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন

মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে ফেনী সদর, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার কমপক্ষে ২০টি জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
দেশের ১৪ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কার্যকারিতাও প্রশ্নের মুখে
দেশের ১৪ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কার্যকারিতাও প্রশ্নের মুখে |সংগৃহীত

ফেনীতে ভারী বৃষ্টির কারণে বাঁধ ভেঙে হঠাৎ বন্যায় তিন উপজেলার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে পানিবন্দীদের উদ্ধারের কাজে বেগ পেতে হচ্ছে।

দেশের ১৪ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কার্যকারিতাও এখন প্রশ্নের মুখে।

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম নিজেই পড়েছেন অসহায় অবস্থায়। বুধবার বিকেল ৫টার দিকে সার্বিক বন্যা পরিস্থতির খবর জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। আমি আমার উপজেলার পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার করতে পারছি না। অসহায়ের মতো বসে আছি। আমার নৌকা দরকার। নৌকা ছাড়া তাদের আমি কিভাবে উদ্ধার করব!’

তিনি বলেন, ‘আমার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। তাদের জন্য খাবারসহ সব প্রস্তুতি আছে। কিন্তু তাদের আমি কিভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে আনব? তাদের কাছে যাওয়ার তো কোনো উপায় নেই। তারাও তো আসতে পারছেন না। আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার এখন প্রয়োজন নৌকা। পানিবন্দী মানুষকে নৌকা ছাড়া তো উদ্ধার করতে পারব না।’

তিনি জানান, ‘পুরো উপজেলার সব ইউনিয়নেই বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আশ্রয় কেন্দ্রও এখন ডুবে যাচ্ছে। মানুষকে কিভাবে রক্ষা করব তাই বুঝে উঠতে পারছি না।’

মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে ফেনী সদর, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার কমপক্ষে ২০টি জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে। আর তাতে তিনটি উপজেলার অনেক গ্রামই পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানির তোড়ে অনেকের ঘর-বাড়ি, গবাদিপশু, খামার, ফসল সব কিছু ভেসে গেছে। কমপক্ষে ৪০টি গ্রাম পানির নিচে চলে গেছে। ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।

ফেনীর মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর তীরের ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের আরো আনেক এলাকা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে ফেনী জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড।

ফেনী জেলা আবহাওয়া কর্মকর্তা মজিবুর রহমান জানান, গত তিন দিনে এই মৌসুমে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছি ফেনীতে। আগামী শনিবার পর্যন্ত মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত থাকবে। গত ২৪ ঘণ্টায় হয়েছে ১৪১ মিলিমিটার।

ফেনীর ফুলগাজীর নোয়াপুর গ্রামের আসিয়া বেগম বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে হঠাৎ বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের বাড়ি-ঘর, পুকুর সব কিছু পানির নিচে তলিয়ে যায়। আমার ঘরের আসবাপত্র ও বেড়া ধরে নিজেদের রক্ষা করি। এখনো আমাদের ঘরে কোমর সমান পানি। আমাদের আশপাশের বাড়িঘরও একইভাবে তলিয়ে গেছে।’

একই গ্রামের মানিক চন্দ্র পাল নতুন মুরগির খামার করেছিলেন। খামারে এক হাজার ৩০০ মুরগি ছিল। পুরো খামারের মুরগিই ভেসে গেছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আর আমরা কিছু নেই। এই গ্রামের আর সবার অবস্থাও একই রকম। আমরা এখন পানিবন্দী আছি।’

তার কথা, ‘বেড়িবাঁধ না ভাঙলে এই অবস্থা হতো না। আমরা ইট, বালু দিয়ে বাঁধ রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি।’

পরশুরাম উপজেলার মির্জানগরের সত্যনগর গ্রামের মিন্টু হাওলাদার বলেন, ‘প্রতিবছরই আমরা এই পরিস্থিতির শিকার হই। এক মাস আগেও আমাদের এলাকায় বন্যা হয়। তারপর বাঁধগুলো মেরামত করা হয়েছিল। কিন্তু তা নামে মাত্র মেরামত করা হয়। ফলে গত রাতে নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে ওঠার সাথে সাথে সবগুলো বাঁধ ভেঙে যায়।’

উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: আবুল কাশেম বলেন, ‘ফেনী জেলায় ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। বলতে গেলে এর পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৯ থেকে ২০২৪- এই পাঁচ বছর একটি প্রজেক্ট ছিল, তখন বাঁধ মেরামত করা হয়। এরপর আর মেরামত করা হয়নি। পুরো ফেনী জেলার বন্যা প্রতিরোধ এই বেড়িবাঁধের ওপর নির্ভর করে। মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে ফেনীকে রক্ষা করা যায় না। এ তিন নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে গেলে বাঁধ ভেঙে জনপদ তলিয়ে যায়।’

তার কথায়,‘স্থানীয় বৃষ্টি তো আছেই। তার সাথে ত্রিপুরা থেকে আসা উজানের পানি যুক্ত হয়েছে।’

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: ইসমাইল হোসেন জানান, ‘জেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখন পর্যন্ত ৩৮০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তিন উপজেলায় ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তবে সব আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো লোক ওঠেনি। প্রাথমিক হিসাবে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা। আমাদের সার্বক্ষণিক ৯০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। আরো বেসরকারি সংগঠন প্রস্তুত আছে। আমরা শুকনা ও রান্না করা খাবার দিচ্ছি। আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি আছে।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপণা অধিদফতর জানিয়েছে, ভারী বৃষ্টির কারণে কুমিল্লা, নোয়াখালী খাগড়াছড়িসহ আরো কিছু এলাকায় বন্যার আশঙ্কা আছে। টানা বৃষ্টির কারণে নোয়াখালীর পাঁচ উপজেলা প্লাবিত হচ্ছে। জেলা সদর, সুবর্ণচর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও বেগমগঞ্জ উপজেলার সাথে গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগের সড়কগুলো ইতোমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উঠে গেছে বিভিন্ন অফিস-আদালত ও বিদ্যালয়ে।

ঢাকার আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেসা বলেন, ‘ভারী বৃষ্টি কমে আসছে। বন্যা পারিস্থিতির উন্নতি হবে।’

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনিষ্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আনিসুল হক বলেন, ‘আসলে আমাদের বেড়িবাঁধগুলো মাটির তৈরি। ফলে ভেঙে যায়। এটা পরিস্থিতি খারাপ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড চেষ্টা করছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। আমাদের আগাম সতর্ক বার্তা ব্যবস্থা ভালোই আছে। কিন্তু সেটা তো মানুষের কাছে পৌঁছায় না। মানুষ তো ওই ভাষা বোঝে না।’

তিনি বলেন, ‘আসলে সহজ ভাষায় সতর্কবার্তা না হওয়ায় মানুষ সরে যায় না। আশ্রয় কেন্দ্রে যায় না। আগাম প্রস্তুতি নেয় না। এটার জন্য কাজ করা দরকার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটারের মতো বাঁধ আছে। কিন্তু এগুলোর ডিজাইন এবং এর নির্মাণ উপকরণে সমস্যা আছে। ফলে যখন পানির ওয়েভ আসে, সেগুলো টেকে না। আর এগুলো হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয় না।’

তার কথায়, ‘দুর্যোগ বা বন্যা ব্যবস্থাপনার তিনটি পর্যায় আছে। দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগ পরবর্তী। এই তিনটি কাজ সমন্বয় না করে করলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সঠিক হয় না।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘আমরা সারা বছরই বন্যাসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকি। এখন যে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ফেনীতে বন্যা হচ্ছে, সেখানে আমরা সক্রিয় আছি। আরো তিন-চারটি জেলার জন্যও আমাদের প্রস্তুতি আছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব আশ্রয়কেন্দ্র সারাদেশে আছে প্রায় এক হাজার। এছাড়া প্রয়োজনে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের ভবনকে আমরা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করি। দেশের প্রতি উপজেলায় টিন কেনার জন্য ১২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া আছে। শুকনা খবার কেনার জন্য দেশের প্রতিটি উপজেলায় ছয় লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া আছে। আর জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যন্ত আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। তারা নিয়মিত সভা করেন। আমাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কমিটিগুলো জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সবার সাথে সমন্বয় করে কাজ করে। উপজেলা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আছে। আমরা আবহাওয়া অধিদফতর থেকে নিয়মিত আবহাওয়া বুলেটিন নিয়ে তার প্রচার করি। সতর্ক করি।’

তবে তার কথা, ‘মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। তারা অনেক সময় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না।’

সূত্র : ডয়চে ভেলে