বাংলাদেশ দলের থাকার কথা ছিল গ্রুপ শীর্ষে। বিশেষ করে এবারের এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে তিন ম্যাচ শেষে জামাল ভূঁইয়ারা সবার উপরে থাকলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকতো না। অন্তত তিন ম্যাচে প্রতিপক্ষগুলোর শক্তির বিপরীতে তারা যেভাবে জয়ের সুযোগগুলো হাতছাড়া করেছে তা জয়ে রূপান্তরিত করতে পারলে পেছনে থাকতো ভারত, হংকং ও সিঙ্গাপুর। অথচ প্রতি ম্যাচেই গোল মিস, নিজেদের ভুলে প্রতিপক্ষকে গোল উপহার এবং কিছু সময়ের জন্য বাজে খেলেই এখন বাদ পড়ার শঙ্কায়। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের বৈতরনী পার হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার আশা প্রবল ভাবে জিইয়ে রাখার জন্য পরশু হংকংয়ের বিপক্ষে জয়ের বিকল্প ছিল না লাল-সবুজদের। সেখানে লিড নিয়েও তাদের হারতে হয়েছে ৩-৪ গোলে। তাও শেষ মিনিটের গোলে। অথচ ৯ মিনিট ইনজুরি টাইমের খেলা ১১ মিনিট পর্যন্ত খেলানো হয়। ওই ৯ মিনিটে বাংলাদেশ স্কোর ৩-৩ করলেও ১১ তম মিনিটে চতুর্থ গোল হজম। বাংলাদেশকে হারিয়েই ‘সি’ গ্রুপের শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে হংকং। বাংলাদেশ এখন ১ পয়েন্ট নিয়ে তলানীতে। পরশু ভারত ১-১ গোলে সিঙ্গাপুরের সাথে ড্র করে তৃতীয় স্থানে চলে গেছে। ৫ পয়েন্ট পাওয়া সিঙ্গাপুর দ্বিতীয় স্থানে।
কার্যত: বাংলাদেশ দলের আশা শেষ এশিয়ান কাপের ফাইনাল রাউন্ডে উঠার। বাকীট নির্ভর করছে যদি কিন্তুর উপর। যদি বাংলাদেশ ১৪ অক্টোবর সহ বাকী তিন ম্যাচে জিততে পারে তাহলে ক্ষীণ আশা থাকবে। সাথে অন্য দলের পারস্পরিক ম্যাচের ফলও লাল-সবুজদের পক্ষে যেতে হবে। হংকং দল পরশু রাতেই চাটার্ড ফ্লাইটে দেশে ফিরে গেছে। আর বাংলাদেশ দল গতকাল দুপুরে হংকংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। আজ তারা অনুশীলনে নামবে। হংকংয়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভ’ঁইয়া জানান, আমরা পরের তিন ম্যাচে জিততে চাই। পরশু ম্যাচ শেষেও এই পরের তিন ম্যাচে জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেন হামজা চৌধুরী ও শমিত শোম।
তিন ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে ভারতের সাথে গোল মিসের মহড়া দিয়ে গোলশূন্য ড্র করে। এরপর দেশে নিজেদের গোল মিস ও গোলরক্ষক এবং ডিফেন্ডারদের ভুলে সিঙ্গাপুরের কাছে হার। আর পরশু একই চিত্রনাট্য। অথচ তিন প্রতিপক্ষের যে শক্তি তাতে তাদের বিপক্ষে ভুল গুলো না করলে তিন ৯ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষেই থাকতে পারতো বাংলাদেশ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন বারবার এভাবে হাতাশার কাহিনী রচনা করে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। নিজেরা পারে না শেষ মুহুর্তে গোল দিয়ে ম্যাচ বের করতে। উল্টো ওই সময়ে গোল হজম করে ড্র করতে বাধ্য হওয়া বা হার। হংকংয়ের বিপক্ষে লিড নেয়া বাংলাদেশ দল এক পর্যায়ে ১-৩ গোলে পিছিয়ে পড়ে। ৮২ মিনিট পর্যন্ত এই স্কোর লাইনে পিছিয়ে থাকলেও ৮৩ মিনিটে তা হয়ে যায় ২-৩ এ। আর ৯৯ মিনিটে ৩-৩। অথচ এরপরও হাতাশা নিয়ে মাঠ ত্যাগ।
এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলে দূর্দান্ত পারফর্ম করা গোলরক্ষক মেহেদী হাসান শ্রাবণকে না খেলানো, ফাহামিদুল, জায়ানদের প্রথম একাদশে না রাখা নিয়ে সমালোচনার মুখে কোচ কাবরেরা।
এই প্রসঙ্গে বাফুফে ও ন্যাশনাল টিমস কমিটির সদস্য ও মোহামেডানের গোলরক্ষক কোচ ছাঈদ হাছান কাননের মতে, ১-৩ গোলে পিছিয়ে থেকে এরপর সেই স্কোর লাইন ৩-৩ করাটা বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য একটা রেকর্ড। নতুন ইতিহাস। এরপরও সেই ম্যাচে শেষ সময়ে গোলে হেরে যাওয়াটা দায় কোচ এবং কোচিং স্টাফদেরই নিতে হবে। তারা কেন শেষ সময়ে ম্যাচটি অন্তত: ড্র করার কৌশল নিতে বলতে পারলো না ফুটবলারদের।’ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক কানন এই ব্যর্থতার জন্য ফুটবলারদেরই দায়ী করলেন। তার মতে, ফুটবলাররা যদি এভাবে প্রতিপক্ষকে গোল উপহার দেয় তাহলে কিভাবে একটি দল জিতবে। কোচতো আর মাঠে নেমে খেলবে না। খেলতে হবে ফুটবলারদের। অভিজ্ঞ ফুটবলাররা এভাবে ভুল করলে হার এড়ানো যাবে কিভাবে। গোলরক্ষক মিতুলতো দুই ম্যাচেই গোল খাইয়েছেন। এরপর যোগ করেন, আসলেই আমরা দূর্ভাগা। তা না হলে শেষ সময়ে এভাবে কেউ গোল খায়। আরো জানান, প্রবাসী ফুটবলারদের তুলনায় স্থানীয়রা সেভাবে খেলতে পারেননি।
কানন অবশ্য একাদশ গঠন নিয়ে কোচ কারবেরার সমালোচনা করলেন না। তার মতে , ঠিক একাদশই খেলিয়েছেন কাবরেরা। বিরতির পর জামাল, জায়ান, ফাহামিদুলরা নামার পর খেলায় পরিবর্তন এসেছিল। তাতেই স্কোর ৩-৩ হয়। জায়ান, ফাহামিদুলরা বয়সে তরুন। তাদের এভাবেই বদলী হিসেবে খেলিয়ে খেলিয়ে তৈরী করতে হবে। শুরুতেই বড় দলের বিপক্ষে নামিয়ে দিলে ব্যর্থ হওয়ার পর ক্যারিয়ারই শেষ। মনে রাখতে হবে জায়ান কিন্তু আমাদের সেরা এক আবিস্কার।
শেষ সময়ের গোলে বাংলাদেশ দলের জিততে না পারা বা হেরে যাওয়াটা নতুন কিছু নয়। গত ১৪ বছরের ইতিহাস টানলে দেখা যায়, ২০১১ সালের সাফে ৯৫ মিনিটে গোল খেয়ে নেপালের কাছে ০-১ এ হার বাংলাদেশের। ২০১৩ সাফে ৯৩ মিনিটের গোলে ভারতের সাথে ১-১ এ ড্র করতে বাধ্য হওয়া। সেই আসরেই পাকিস্তানের কাছে ৯২ মিনেটে ১-২ এ হার। ২০১৫ সাফে মালদ্বীপের কাছে ৯০ ও ৯৫ মিনিটে দুই গোল হজম করে ১-৩ এ পরাজয়। সে বছরই বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ফাইনালে মালয়েশিয়ার কাছে ৯২ মিনিটে গোলে ২-৩ এ হ হার বাংলাদেশের। ২০২৩ সালের সাফের সেমিতে কুয়েতের কাছে ১০৭ মিনিটে গোল খেয়ে ছিটকে পড়া। ২০২১ সাফে নেপালের কাছে ৮৮ মিনিটে গোল হজম করে ড্রতে স্বপ্ন ভঙ্গ।
সিনিয়র দলের মতো বয়সভিত্তিক ফুটবলেও এই কাহিনী। ২০১৭ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলে ৯৪ মিনিটে আত্মঘাতী গোলে ০-১ এ উজবেকিস্তানের কাছে হার। এবার এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলে ইয়েমেনের কাছে ৯৫ মিনিটে গোল খেয়ে বাদ পড়ার কস্ট।
পুুরুষ দল শেষ সময়ের গোলে হারলেও বিপরীত চিত্র নারী ফুটবলে। সেখানে বাংলাদেশের নারীরা শেষ সময়ের গোলে জিতছে। এবারের অনূর্ধ্ব-২০ সাফে নেপালের বিপক্ষে এবং অনূর্ধ্ব-১৭ সাফে ভারতের বিপক্ষে এভাবেই জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ।