হামজার আগমন ও নারী ফুটবলে অভাবনীয় সাফল্য

হামজা চৌধুরীর আগমনে পুরুষ ফুটবলে নতুন জাগরণ ও ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ, যদিও এশিয়ান কাপের মূল পর্বে ওঠা হয়নি। অন্যদিকে নারী ফুটবলে অভাবনীয় সাফল্যে সিনিয়র ও অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়ান কাপে প্রথমবার চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়ে বছরটিকে স্মরণীয় করেছে লাল-সবুজের মেয়েরা।

রফিকুল হায়দার ফরহাদ
হামজার আগমন ও নারী ফুটবলে অভাবনীয় সাফল্য
হামজার আগমন ও নারী ফুটবলে অভাবনীয় সাফল্য |সংগৃহীত

২০২৫ সালটা বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ছিল ঘটনা বহুল। সাফল্য-ব্যর্থতা, আলোচনা সমালোচনা সবই ছিল। নারী ফুটবলে ইতিহাস গড়ে এশিয়ান কাপের দুই বিভাগে চূড়ান্ত পর্বে খেলার টিকিট অর্জন। এর আগে কোচ পিটার বাটলারের বিপক্ষে সাবিনা খাতুনের নেতৃত্বে ১৮ ফুটবলারের ‘বিদ্রোহ’। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে হামজা চৌধুরীর আগমন।

ইংল্যান্ডের লেস্টার সিটির এই ফুটবলার বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সাথে সাথেই পাল্টে গেছে পুরো দেশের ফুটবল চিত্র। দর্শকরা যেমন মাঠে ছুটেছেন, স্পন্সররাও রেসে নেমেছেন বাফুফে ও বাংলাদেশ দলের সাথে সম্পৃক্ত হতে। লাল-সবুজ জার্সি গায়ে হামজা এবার বাংলাদেশকে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে যেতে পারেননি। তবে বাংলাদেশ দলের হয়ে ৪ গোল করেছেন। তার উপস্থিতিতেই ঢাকার মাঠে ভারতের বিপক্ষে ২২ বছর পর জয় বাংলাদেশের। নতুন করে জাগরণ শুরু হয়েছে দেশের ফুটবলে।

চলতি বছর সিনিয়র জাতীয় ফুটবল দলের মিশন শুরু হয় মার্চে এশিয়ান কাপের ম্যাচ দিয়ে। ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ গোল শূন্যতে ড্র করে ভারতের সাথে। ওই ম্যাচ দিয়েই বাংলাদেশ দলে হামজা চৌধুরীর অভিষেক। সেই ম্যাচেই হাভিয়ার কাবরেরা বাহিনী জয়ের দেখা পেত যদি মজিবুর রহমান জনি গোলের দু’টি সহজ সুযোগ মিস না করতেন। ভারত যাওয়ার আগেই বাংলাদেশে এসে ঘুরে যান হামজা।

তবে হামজার ঢাকায় মাঠে খেলতে লেগে যায় জুন মাস। জুনে ভুটানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে অভিষেকেই গোল এই মিডফিল্ডারের। তার মতোই আরেক প্রবাসী ডেনমার্ক থেকে আসা মিডফিল্ডার জামাল ভূঁইয়ার কর্নার থেকে হেডে গোল করেন তিনি। এরপর নেপালের বিপক্ষে জোড়া গোল। এর মধ্যে তার দ্বিতীয় গোলটি ছিল বাইসাইকেল কিকে।

এরপর হংকংয়ের বিপক্ষে ফের জালের দেখা পাওয়া। সে গোলটি দূর্দান্ত এক ফ্রি-কিকে। এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে ১৮ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে শেষ হোম ম্যাচে জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। তবে এই জয় যদি জুনে সিঙ্গাপুর এবং অক্টোবরে হংকংয়ের বিপক্ষে হতো তাহলে হয়তো এবারই এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার টিকিট মিলত। গোলরক্ষক ও ডিফেন্ডারদের ভুলে সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের কাছে হারে সব শেষ।

তবে ২০২৫ সালে বাংলাদেশ দল শেষ দুই হোম ও অ্যাওয়ে ম্যাচে অপরাজিত ছিল। হংকংয়ে গিয়ে বাংলাদেশ ১-১ গোলে ড্র করে হংকংয়ের সাথে। আর হোমে ভারতের বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়।

হামজা চৌধুরীর প্রতিনিধিত্বে বাংলাদেশ তিনটি ম্যাচে জিতেছিল। ভুটান, নেপাল ও ভারতের বিপক্ষে জয়। এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে হাভিয়ার কাবরেরা বাহিনীর ব্যর্থতার পরও সবাই কিন্তু তা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ভারতের বিপক্ষে জয়ে। আসলে হোমে শেষটা জয়ে হওয়া আর ‘চিরশত্রু’ ভারতের বিপক্ষে বিজয়ের হাসিই এই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। তবে দল কোয়ালিফাই না করতে পারার কষ্ট ফুটবলপ্রেমীরা ভুলতে পারবে না লম্বা সময় ধরেই।

এই বছর ব্যর্থ মিশনের পর শেষ ম্যাচে জয় বা ড্র করে কস্ট ভুলে যাওয়ার ঘটনা একাধিক বার ঘটেছে। এবারের অনূর্ধ্ব-১৭ নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বাংলাদেশ। মাহাবুবুর রহমান লিটুর দল বয়সভিত্তিক নারী সাফে প্রথমবার ড্র করে ভুটানের সাথে। ওই ড্রই থিম্পুর মাঠে চ্যাম্পিয়ন হতে দেয়নি অর্পিতা বিশ্বাসদের। সাথে ছিল প্রথম লেগে ভারতের কাছে হারের ঘটনা। তবে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ ৪-৩ গোলে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিততে না পারার দুঃখ লাঘবের চেষ্টা করেছে।

ভিয়েতনামে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দল এএফসির বাছাই পর্ব খেলতে গিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল কোয়ালিফাই করা। তবে প্রথম দুই ম্যাচে হারের সাথে সাথেই বিদায়। তবে শেষ ম্যাচে সিঙ্গাপুরকে ৪-১ গোলে হারিয়ে শেখ মোরসালিনরা ভুলিয়ে দিয়েছেন কোয়ালিফাই করতে না পারার বেদনা। শেষটা করেছে নাসরিন স্পোর্টস অ্যাকাডেমি। নেপালে প্রথম নারী সাফ ক্লাব কাপ খেলতে গিয়ে কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি। তবে দ্বিতীয় ম্যাচে করাচী সিটি এফসির সাথে ড্র করার পর শেষ ম্যাচে ভুটানের ট্রান্সপোর্ট ইউনাইটেরে সাথে গোল শূন্য ড্র করে। পুরুষ ফুটবলে আরো ব্যর্থতা ছিল। সাফ অনূর্ধ্ব-১৭ এবং সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলে ফাইনালে ভারতের কাছে টাইব্রেকারে হেরে যাওয়া। সফলতা আসেনি এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবলেও।

তবে নারী ফুটবলে বাংলাদেশ ইতিহাস গড়েছে। প্রথমবার নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার পাশাপাশি এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবলেরও ফাইনাল রাউন্ডে কোয়ালিফাই করেছে। মিয়ানমারের মাঠে বাংলাদেশ স্বাগতিক মিয়ানমার, তুর্কমেনিস্তান ও বাহরাইনকে হারিয়ে মার্চে অস্ট্রেলিয়ায় নারী এশিয়ান কাপে খেলার ছাড়পত্র অর্জন করেছে। এর পরপরই অনূর্ধ্ব-২০ দল নারী সাফে শিরোপা জিতে সাফল্য পায় লাওসের মাটিতেও। সেখানে লাওস ও পূর্ব তিমুরকে হারিয়ে এপ্রিলে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এই সাফল্যের হ্যাটট্রিক হয়নি জর্দানের মাঠে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দল এএফসির আসরের বাছাই পর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে ব্যর্থ হয়ে।

তবে নারী ফুটবলের বিব্রতকর অবস্থার জন্ম দেন সাবিনা খাতুনের নেতৃত্বে ১৮ ফুটবলার। তারা কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সোজা জানিয়ে দেয় এই বৃটিশ কোচ থাকলে তারা খেলবে না। তবে বাফুফে কঠোর হস্তে এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করে। ১৮ জন বাদ দিয়েই দল পাঠায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রীতি ম্যাচ খেলতে। সেখানে দুই ম্যাচে হারের পর বিদ্রোহীদের বড় অংশকে জাতীয় দলে ফের ডাকা হয়। বাদ পড়ে যান সাবিনা, মাছুরা, সানজিদা, কৃষ্ণা, সুমাইয়ারা। এদের ছাড়াই এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করা। যদিও নভেম্বরে ট্রাইনেশন ফুটবলে মালয়েশিয়া ও আজারবাইজানের কাছে হার আফঈদা খন্দকারদের। সাবিনাদের মূল জাতীয় দল থেকে বাদ দেয়া হলেও পরে ফুটসলা জাতীয় দলে ডাকা হয়।

ক্লাব ফুটবলের এএফসি কাপের প্লে-অফে ঢাকা আবাহনী কিরগিজস্তানের মুরাস এফসির কাছে হেরে ছিটকে পড়লেও বসুন্ধরা কিংস সিরিয়ার আল কারামাহকে হারিয়ে এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে কোয়ালিফাই করে। তবে গ্রুপে হতাশ করেছে বসুন্ধরা কিংস।

এই বছরেই প্রথমবারের মতো পেশাদার লিগ শিরোপা জয় করে মোহামেডান। তবে লাইসেন্স না থাকায় এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে খেলতে পারেনি। তাদের বদলে খেলে বসুন্ধরা কিংস। ফেডারেশন কাপ অবশ্য ঘরে তুলেছে বসুন্ধরা কিংস।