দীপ্তি শর্মা ও শেফালি বর্মার ঝড়ো ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে প্রথম নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস গড়ল ভারত। সেইসাথে ২৫ বছর পর নারীদের ক্রিকেট পেল নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়নও।
২০০০ সালে তৃতীয় দেশ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল নিউজিল্যান্ড। তারপর থেকে সব খেতাব ভাগ করে নিয়েছে প্রথম দুই চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড।
রোববার নবি মুম্বাইয়ের ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে নারীদের বিশ্বকাপ ফাইনালে শুরুতেই দাপট দেখায় ভারত। ওপেনার স্মৃতি মান্ধানা ও শেফালি বর্মা বাউন্ডারির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। যার জেরে প্রথম থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকা জোর চাপে পড়ে যায়। তারপর দীপ্তি শর্মার দাপুটে বোলিংয়ে ধরাশায়ী হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
এদিন দুপুরজুড়ে বৃষ্টির পর শেষ পর্যন্ত হাসি ফেরে নবি মুম্বাইয়ে। অবশেষে নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ শুরু হয় সময়মতোই। তবে টসে জিতে প্রথমে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। ফলে ব্যাট হাতে নামতে হয় ভারতীয় নারী দলকে। ম্যাচের শুরু থেকেই দাপট দেখায় ভারত। ওপেনার স্মৃতি মান্ধানা ও শেফালি বর্মা বাউন্ডারির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। যার জেরে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা জোর চাপে পড়ে। দাপটের সাথে শুরুটা করেন শেফালি। আয়াবোঙ্গা খাকার প্রথম ওভারেই কভারের উপর দিয়ে বাউন্ডারি মেরে রানের খাতা খোলেন। পরের ওভারে মারিজান কাপের সামনে ধৈর্য ধরে খেললেও তৃতীয় ওভারেই স্মৃতি অফ সাইডে দুর্দান্ত ড্রাইভে চার হাঁকান মান্ধানা। এরপর শুরু হয় দুই ওপেনারের পালা করে বাউন্ডারি-ঝড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্ধশতরান করতে পারেননি না স্মৃতি মন্ধানা। ক্লোয়ি ট্রিয়নের বলে ৪৫ রান করে আউট হন তিনি। ১০৪ রানে প্রথম উইকেট হারায় ভারত। তবে মন্ধানা সুযোগ হারালেও অর্ধশতরান করেন শেফালি বর্মা। ৪৯ বলে ৫০ পূর্ণ করেন তিনি। এর পর পরই বাঁ পায়ের পেশিতে টান ধরে শেফালির। তা সত্ত্বেও বড় শট খেলার চেষ্টা করছিলেন। তা করতে গিয়েই ৮৭ রানে আউট হয়ে যান শেফালি। খাকার বলে ক্যাচ দেন লুসের হাতে।
তবে সেমিফাইনালের নায়ক জেমাইমা খুব বেশি রান করতে পারেননি না ফাইনালে। খাকার বলে কভারে উলভার্টের হাতে ক্যাচ দিয়ে ২৪ রান করে সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। এরপরে সামগ্রিকভাবে রান তোলার গতি বেশ খানিকটা কমে যায় ভারতের। ক্রিজে দুই নতুন ব্যাটার একটু ধরে খেলার চেষ্টা করেন। এরমধ্যেই খারাপ একটি শট খেলে আউট হন হরমনপ্রীত কৌর। এমলাবার বল এসে উইকেট ভেঙে দেয়। ২০ রানে করেই ফিরতে হয় হরমনপ্রীতকে। ডি ক্লার্কের বলে সোজা মেরেছিলেন আমনজ্যোৎ কৌর। কিন্তু এক হাতে ক্যাচ লুফে নিতে দেরি করেননি ডি ক্লার্ক। ততক্ষণে ভারতের স্কোর ২৫২-৫। তবে প্রতি বলে রান করে গিয়েছেন দীপ্তি শর্মা। দ্রুত অর্ধশতরান করে ফেলেন তিনি। তারমধ্যে চালিয়ে খেলতে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরে আসেন রিচা ঘোষ। খাকার বলে ক্যাচ ধরেন ডার্কসেন। ৩৪ রান করেন রিচা। কিন্তু শেষ দুই ওভারে তেমনভাবে খেলতে পারেনি ভারত। যেখানে চার-ছয় মারার কথা, সেখানে এক-দু’রানের উপরেই ভরসা করতে হয়েছে তাদের। ফলে ৩০০ রান যেখানে হেসেখেলে উঠে যাবে মনে হচ্ছিল, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে ২৯৯ রানের লক্ষ্য রাখে ভারত।
ব্যাট করতে নেমে প্রথম দিকে ভারতের চাপ বাড়াচ্ছিল প্রোটিয়ারা। তবে ভুলবশত রেণুকার বল অফে ঠেলে রান নিতে গিয়েছিলেন ব্রিটস। শেষমেশ আমনজ্যোতের থ্রোয়ে রান আউট হন তিনি। সোজা দৌড়লে হয়তো ঢুকে যেতে পারতেন। এরপর চরণীর বল খেলতে না পেরে এলবিডব্লিউ হন বশ। তবে এখানেই থিম থাকেনি ভারতের বোলারদের। চাপ আরো বাড়াতে থাকে তারা। বিশেষজ্ঞ বোলারেরা উইকেট তুলতে না পারায় ফাটকা খেলেছিলেন হরমনপ্রীত কৌর। এরপর শেফালি বর্মাকে বল দেন তিনি। পার্ট-টাইম স্পিনার হওয়ায় শেফালির বলে মারার চেষ্টা করেন সুনে লুস। সেটা করতে গিয়ে উইকেট দিয়ে আসেন তিনি। এক দিনের ক্যারিয়ারে এর আগে মাত্র ১৪ ওভার বল করেছিলেন শেফালি। সেই বোলারই মাঝখানে ভারতকে ম্যাচে ফেরান। এরপর আউট হন অভিজ্ঞ মারিজান কাপও। দক্ষিণ আফ্রিকাকে জোড়া ধাক্কা দেন শেফালি। এদিকে, প্রচুর বল খেলছিলেন সিনালো জাফটা। কিন্তু রান পাচ্ছিলেন না। তাই মরিয়া হয়ে মারতে গিয়ে উইকেট দেন তিনি। আর তাকে সাজঘরে পাঠান দীপ্তি। তখন ৩০ ওভার শেষে ৫ উইকেটে ১৫০ রান প্রোটিয়াদের।
রাধা যাদব বল হাতে ঠিক করে ধরতে পারছিলেন না। তাই এক ওভারে ১৭ রান দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রান রেট আগের জায়গায় নিয়ে আসেন। ৩২তম ওভারের শেষ দুই বলে জোড়া ছক্কা মারেন আন্নেরি ড্রেকসেন। তার হাত ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৭৫ রানে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে, একটি নো বল থেকে ছয়, পরের ফ্রি হিট থেকেও ছয় খেয়েছেন রাধা। তবে রাত যত বাড়তে থাকে মাঠে শিশিরও তত পড়তে শুরু করে। এরপরেই ভারতীয় স্পিনারদের আসল পরীক্ষা শুরু হয়। একেবারে শেষ মুহূর্তে ডার্কসেনকে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ আসে ভাতের হাতে। কিন্তু হাতের ক্যাচ ফেলে দেন দীপ্তি। নিচু হতেই অনেকটা সময় নেন তিনি। তবে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দীপ্তির ফ্লাইটেড বল সামনের পায়ে খেলতে গিয়েছিলেন ডার্কসেন। বুঝতে না পেরে বোল্ড হয়ে যান ডার্কসেন। ৩৭ বলে ৩৫ রান করে মাঠ ছাড়েন তিনি। এরপরেই বিশ্বের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে সেমিফাইনাল ও ফাইনালে শতরান করেন লরা উলভার্ট। তবে আর বেশি সময় মাঠে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি উলভার্ট। অবশেষে দীপ্তি শর্মা তুলে নেন প্রোটিয়া ক্যাপ্টেনের উইকেট। ৯৮ বলে ১০১ রান করে আউট হন লরা। তার দু’বল পরেই আর এক বিধ্বংসী ব্যাটার ক্লো ট্রায়নকেও তুলে নেন দীপ্তি। এক কথায় এক ওভারে দীপ্তির দুটি উইকেটই বিশ্বকাপটাই এনে দিল ভারতকে। এরপরে ডি ক্লার্ক ওভারের শেষ বলে দ্রুত রান নিতে গিয়েছিলেন। দৌড় শেষ করার আগেই আউট করে দেন রিচা। তারপরে ৪৫.৩ ওভার, দীপ্তির বলে শট মারেন ক্লার্ক। আর দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়ে দলকে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন হরমনপ্রীত কৌর। সেইসাথে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলো ভারত। তৃতীয় বারের চেষ্টায় ট্রফি জয়ের স্বাদ পেল টিম ইন্ডিয়া।



