ক্রিকেটের এক রহস্যের নাম শেন ওয়ার্ন

সবার শেষ যেখানে, সেখান থেকেই যেন তার শুরু। বল যেন ছিল তার পোষ্য, যেন তার কথা শুনতো। যখন যেভাবে বলতেন সেভাবেই যেন প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতো। সব মিলিয়ে ওয়ার্ন ছিলেন এক অদ্ভুতুড়ে রহস্য।

আফ্ফান উসামা
শেন ওয়ার্ন
শেন ওয়ার্ন

ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কতো কতো রথি-মহারথির দেখা মিলেছে, কতো তারকা-মহা তারকা এসেছেন, নাম লিখেছেন সোনালী কালিতে। তবে একজন শেন ওয়ার্ন যেন সবার থেকে ভিন্ন। ক্রিকেট খেলতেন, অথচ ‘জাদুকর’ ছিল খ্যাতি। এমনিই এমনিই তো ওই স্বীকৃতি জুটেনি!

ক্রিকেটের এক বিস্ময় ছিলেন ওয়ার্ন। সবার শেষ যেখানে, সেখান থেকেই যেন তার শুরু। বল যেন ছিল তার পোষ্য, যেন তার কথা শুনতো। যখন যেভাবে বলতেন সেভাবেই যেন প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতো। সব মিলিয়ে ওয়ার্ন ছিলেন এক অদ্ভুতুড়ে রহস্য। যে রহস্যের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেননি তাৎকালীন বাঘা বাঘা ব্যাটাররাও।

ওয়ার্ন নিজেকে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছেন যে, ওয়ার্ন যুগের পর থেকে যত লেগস্পিনার আসবে ক্রিকেটে, সবাইকে মাপা হচ্ছে/হবে ওয়ার্নের মাপকাঠিতে। কেননা এই ওয়ার্নের হাত ধরেই পুর্নজন্ম হয়েছে লেগ স্পিন শিল্পের। আধুনিক ক্রিকেটে যে লেগ স্পিনের এতো চাহিদা, তার পেছনের কারণটা ওয়ার্ন।

নব্বইয়ের দশকে ওয়ার্ন আসার আগে সারাবিশ্বেই চলছিল পেস বোলিংয়ে বিপ্লব। ক্যারিবীয় পেসারদের দেখে তখন সব তরুণই পেসার হতে চেয়েছে। ফ্লেমিং, ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রা থেকে শুরু করে শ্রীনাথ, শোয়েব আখতার কিংবা ড্যারেন গফ, অ্যান্ডি ক্যাডিক, কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোস; ইতিহাসের সেরা পেসারদের রাজত্বই চলছিল তখন।

Shane-Warne-02

সেই আগ্রাসনের দিনে লেগস্পিনের মত সহজ বিষয়ে বিশ্বকে বিমোহিত করেছিলেন ওয়ার্ন। আজকের দিনে লেগস্পিনের এমন জয়জয়কার, সে তো ওই ওয়ার্নের হাত ধরেই। রাশিদ-রদিশরা মুগ্ধতা ছড়িয়ে চললেও তার মত করে আর কেউ আসেনি। শেন কিথ ওয়ার্ন নামটা যেন লেগস্পিনেরই এক সমার্থক!

খেলার মূল কথা যদি হয় বিনোদন, সেটিও ওয়ার্নের চেয়ে বেশি আর কজন দিতে পেরেছে! ওয়ার্নের বোলিং ক্রিকেটকে এমন রূপে-রঙে-রসে সাজিয়ে উপহার দিয়েছে যে কেবল তার বোলিং দেখতেই মাঠে ছুটে গেছেন দর্শক।

ওয়ার্ন বল হাতে নেওয়ামাত্র শুধু ব্যাটসম্যানদের হৃৎকম্পনই বেড়ে যায়নি, গ্যালারির মতো টিভি সেটের সামনে বসা দর্শকও নড়েচড়ে বসেছেন রোমাঞ্চে। আম্পায়ারকেও হতে হয়েছে তৎপর। একটু এদিক সেদিক হলেই পড়তে হয়েছে দ্বন্দ্বে।

অথচ তার শুরুটা ছিল সাদাসিধে। অভিষেক টেস্টে পেয়েছিলেন মোটে ১ উইকেট। আর প্রথম সাত ইনিংস বল করে উইকেট পেয়েছিলেন হাতেগোনা ৫টি। তবে অষ্টম ইনিংসে এসে জানান দেন নিজের সক্ষমতার। আভাস দেন দারুণ কিছুর৷ সেবার ৫২ রানে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট।

Shane-Warne-05

এমন শুরুর পর যখন শেষ করলেন, নামে পাশে তখন সাদা পোষাকে ৭০৮ উইকেট। যেখানে এখন পর্যন্ত তার চেয়ে বেশি উইকেট আছে কেবল মুত্তিয়া মুরালিধরনের, ৮০০। আর ওয়ানডে মিলিয়ে সেই উইকেট সংখ্যা যায় হাজার ছাপিয়ে, ১০০১টি। এখানেও মুরালি এগিয়ে থাকলেও, ওয়ার্নকে ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ খেলতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পাটা পিচে। অন্যথায় কি হতো একবার ভাবুন তো!

ওয়ার্নারের প্রাপ্তি অবশ্য উইকেটেই সীমাবদ্ধ নয়। অধিনায়ক হিসেবেও ওয়ার্ন ছিলেন সময়ের সেরাদের একজন। যদিও জাতীয় দলে নেতৃত্ব পাননি কখনো, তবে তার ক্রিকেট মস্তিষ্ক যে সবার থেকে বেশি সচ্ছ্ব ছিলো; তা অস্বীকার করতে পারবে না কেউ। যার বড় উদাহরণ ২০০৮ আইপিএল। সবচেয়ে কম বাজেটের দল নিয়ে রাজস্থানকে শিরোপা জেতান তিনি।

তাছাড়া, ৯৩-র গ্যাটিং বল, '০৫ এর স্ট্রাউস বল, তার আগে চন্দরপলকে করা বিস্ময় বল তার কীর্তিরই বিস্ময়কর নিদর্শন। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়াকে '৯৯ এর বিশ্বকাপ জিতিয়েও আলোড়ন ফেলে দেন ওয়ার্ন। জেতেন সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ম্যাচ সেরার পুরস্কার। তাছাড়া এক অ্যাশেজ সিরিজে ৪০ উইকেট নিয়ে বসে যান চির অমরত্বের রথে।

লেগ স্পিন বৈচিত্রে যেমন ভরপুর ছিলেন ওয়ার্ন। বৈচিত্রে ভরপুর ছিল তার জীবনও। ক্রিকেটের বাহিরে ভিন্ন এক মানুষ ছিলেন তিনি। বিতর্ক কখনো তার পেছন ছাড়েনি৷ সহ অধিনায়ক থাকা অবস্থায় এক নার্সকে অশ্লীল ম্যাসেজ পাঠিয়ে শোরগোল ফেলে দেন ক্রিকেট পাড়ায়। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে ড্রাগস নেয়া, অবাধ যৌনাচারসহ অনেক অভিযোগ উঠেছে সময়ে সময়ে।

Shane-Warne-04

তবে বড় অভিযোগ ছিল ক্রিকেটের তথ্য পাচার সম্পর্কিত। ক্রিকেট জুয়ায় জড়িয়ে যাবার কারণে শাস্তির মুখেও পড়তে হয় তাকে। তাছাড়া অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর সাথে তিক্ত সম্পর্কের কথাও প্রকাশ পেয়েছিল এক সময়ে। এমনকি একটি ব্রিটিশ প্রতিবেদনেদাবি করা হয় যে, ওয়ার্নের সাথে নাকি হাজার মহিলার সম্পর্ক ছিল!

তার এসব বিতর্কে আকর্ষণটা বেড়েছে বৈ কমেনি! সব মিলিয়ে শেন ওয়ার্ন ছিলেন তাঁর সময়ের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। এমন নন্দিত, এমন বিতর্কিত, এমন আলোচিত ক্যারিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসেই কি আর কারো ছিল!

এমনকি অদ্ভুত সব উপায়ে স্লেজিং করাকে শিল্প বানিয়ে ফেলেছিলেন ওয়ার্ন। ক্রিস কেয়ার্নসকে ব্যাটিংয়ে নামলেই খোঁড়াতে শুরু করতেন, কেয়ার্নস যে বারবার চোটে পড়েন সেটিই মনে করিয়ে দিতেন।

তাছাড়া একবার ওয়ার্নের বল খেলতে গিয়ে সমস্যায় পড়তেন বলে দক্ষিণ আফ্রিকার ড্যারিল কালিনান ক্রীড়া মনোবিদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এমনটা শোনার পর থেকেই কালিনানকে জ্বালিয়ে মারতেন তিনি। দেখা হলেই কালিনানকে ‘ডাক্তারের সোফার রং কী ছিল’?

শুধু তাই নয়, ‘ভবিষ্যতবাণীতেও’ পটু ছিলেন ওয়ার্ন। একবার বলেকয়েই নিউজিল্যান্ডের অ্যান্ড্রু জোন্সকে এলবিডব্লু করেছিলেন ওয়ার্ন। বল করার আগে আম্পায়ার স্টিভ ডানকে ওয়ার্ন বলেন, ‘এবারই হবে।’

একবার ট্রেন্ট ব্রিজে রবার্ট ক্রফট ওয়ার্নকে ছক্কা মেরে বড়া পর্দায় সেটির রিপ্লে দেখছিলেন। বিরক্ত ওয়ার্ন ক্রফটকে বলে ‘চিন্তা কোরো না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার রিপ্লে দেখতে হবে তোমাকে।’ সত্যি হয়েছিল তা, ক্রফটকে আউট করেন ওয়ার্ন। বড় পর্দায় রিপ্লে দেখানো হয় এরপর।

শুধু উইকেট সংখ্যায় ওয়ার্নকে কখনো বিবেচনা করা যাবে না। শেন ওয়ার্নকে বুঝতে হলে, তার বোলিং দেখতে হতো। কবজির মোচড়, বুদ্ধির প্রয়োগ আর প্রাণবন্ত শেন ওয়ার্নকে বোঝাতে ব্যর্থ তাঁর ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান।

তবুও কিংবদন্তির শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে অক্ষম পরিসংখ্যানে একটু চোখ বোলানো যাক—

  • ️আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে শেন ওয়ার্ন নিয়েছেন ১০০১ উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র দুজন বোলারের ১০০০ উইকেট পাওয়ার কীর্তি আছে। অন্যজন মুত্তিয়া মুরালিধরন।
  • ️টেস্ট ক্রিকেটে শেন ওয়ার্নের নেওয়া উইকেট। প্রথম বোলার হিসেবে ৬০০ ও ৭০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন ওয়ার্ন।
  • ️২০০৫ সালে টেস্টে ৯৬ উইকেট নিয়েছিলেন শেন ওয়ার্ন। এক পঞ্জিকাবর্ষে ক্রিকেট ইতিহাসে কোনো বোলার এত উইকেট পাননি।
  • ️টেস্ট ক্যারিয়ারে ওয়ার্ন ১৭ বার ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন। তার চেয়ে কেবল মুত্তিয়া মুরালিধরন ১৯ ও জ্যাক ক্যালিস ২৩ বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন। সমান ১৭ উইকেট আছে ওয়াসিম আকরামের।
  • ️টেস্টে ওয়ার্নে ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ৩৭ বার। টেস্ট ইতিহাসে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তার চেয়ে বেশি আছে কেবল মুত্তিয়া মুরালিধরনের। ৬৭ বার ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি।
  • ️টেস্টে শেন ওয়ার্নের নেওয়া ক্যাচ। মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে ৩০০ উইকেট ও ১০০ ক্যাচ ধরেছেন ওয়ার্ন।
  • ️ক্রিকেট ইতিহাসে শতক না পাওয়া ব্যাটসম্যানদের মাঝে সর্বোচ্চ ৩১৫৪ রান ওয়ার্নের। অবশ্য ২০০১ সালে পার্থে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৯ রানে আউট হয়েছিলেন ওয়ার্ন।
  • ️উইজডেনের চোখে শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন নির্বাচিত হন। অন্য চারজন ছিলেন ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান, গ্যারি সোবার্স, জ্যাক হবস ও ভিভ রিচার্ডস।
  • ️১৯৯৩ সালের ১৯ ডিসেম্বরে মেলবোর্নে ইংল্যান্ডের ফিল ডিফ্রেইটাস, ড্যারেন গফ ও ডেভন ম্যালকমকে পরপর ফিরিয়ে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। ওয়ার্নের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে একমাত্র হ্যাটট্রিক।
  • ️ব্রিসবেনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে ৭১ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন। টেস্টে যা তার ক্যারিয়ারসেরা বোলিং।
Shane-Warne-03

ওয়ার্নের জীবনে আছে আরো অনেক কীর্তি, অসংখ্য বিতর্ক। তবে বিতর্কিত জীবন যাপন করা ওয়ার্ন সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম দিয়ে যান নিজের মৃত্যুদিনে। ২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্ধবীদের সাথে থাইল্যান্ডে ঘুরতে যান ওয়ার্ন। সেখানে ৪ মার্চ বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু কোনো খোঁজ মিলছিল না।

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ওয়ার্নের রুমের দরজায় বন্ধুরা নক করেন। সাড়া না মিললে ভাঙা হয় সেটি, রুমে ওয়ার্নের খোঁজ মিললেও তিনি মাটিতে পড়ে ছিলেন অচেতন অবস্থায়। যেখান থেকে আর কখনো চোখ মেলেননি ওয়ার্ন।

তবে তার মৃত্যু ঘিরে নানান ধোঁয়াশা রয়েছে৷ বলা যায় সারাজীবন রহস্য হয়ে থাকা ওয়ার্ন মৃত্যুতেও রেখে গেলেন রহস্য। আজ তার মৃত্যুর এতো বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো যা থেকে বের হয়ে আসা যায়নি।