ক্রিকেটের ডন : স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান

আপনার মনে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, হালের মারপিটে ক্রিকেটে ব্রাডম্যান কি তার ডনগিরি বজায় রাখতে পারতেন? উত্তর জানাবো দুইভাবে। প্রথমটা, কাজে-কলমে। দ্বিতীয়টা, ব্রাডম্যানের সুরে।

আফ্ফান উসামা
স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান
স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান |সংগৃহীত

অভিষেকেই হোচট, প্যাভিলিয়নে ফেরা মাত্র ১৮ রানে। তবুও অপেক্ষা পরের ইনিংসের, ভালো কিছুর আশায়। আবারো আশায় গুড়েবালি, এবার আরো বিবর্ণ। মাথা নিচু করে ফিরলেন মাত্র ১ রানে।

তবে শেষটা যেনো আরো হতাশার, চিরন্তন আক্ষেপে আবদ্ধ রেখে প্যাভিলিয়নের পথ ধরা যে রানের খাতা খোলার পূর্বেই। সেই শূন্যতেই ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হলো একটি নাম। নামটা এরিক হলিস।

৩০.২৭ গড়ে মাত্র ৪৪টি উইকেট শিকারী হলিসকে ইতিহাসের অংশ ধরে আজও মনে রাখার নেপথ্যে মাত্র ওই একটা বল। যেই বলটায় ব্যাটসম্যানকে শূন্য রানে ফেরানোর পথে, হলিস উত্থান ঘটিয়েছিলেন এক চিরন্তন আক্ষেপের। যা আজও আমাদের পোড়ায়।

কিভাবে সম্ভব? বলছি শুনুন। ধূসর সূচনা লগ্ন আর মলিন শেষের গল্প শুনলেন যার, পুরো কৃতিত্বটাই যে তার। আশাহত সেই সূচনা হতে ব্যথাতুর বিদায়ের মাঝে যে কেটে গেছে বহুকাল। সময়ের হিসাবে যা ২০ বছর।

ধূসর সূচনা সত্ত্বেও সেই ২০ বছরে তার অর্জন তবুও ১০১.৩৯ গড়! সেই তাকেই তার বিদায়ী ম্যাচে শূন্য (০) হাতে ফেরানোর কীর্তিই হলিসকে স্থান দিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আর এই মলিন সমাপ্তির ফলে তার গড়টা নেমে দাঁড়ায় ৯৯.৯৪–এ।

Sir Donald George Bradman 1

৯৯.৯৪ গড় শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নেই কার কথা বলছি। ০০৭ সংখ্যাদ্বয় শোনা মাত্রই যেমন ইয়ান ফ্লেমিংয়ের নিদারুণ হাতের কাল্পনিক সৃষ্টিশীল স্পাই জেমস বন্ডকে মনে ভাবিয়ে তোলে, তেমনি ৯৯.৯৪ শোনা মাত্রই বাইশ গজের এক সত্যিকার জাদুকরের প্রতিচ্ছবি চোখে ভাসায়।

সেই প্রতিচ্ছবির সত্যিকার পরিচয়, স্যার ডন; স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান! ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাজন।

পরিসংখ্যানে তাকালে যদিও ব্রাডম্যানের ক্যারিয়ারের পরিব্যাপ্তি কুঁড়ি বছর দেখায়, কিন্তু সত্যিকারে তা মাত্র এক যুগে সীমাবদ্ধ। বাকিটা সময়টা কেটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামায়। নচেৎ তার দৌড় কতো দূর গিয়ে থামতো, তা কল্পনাকেও হার মানায়।

আর যদি হালের আধুনিক ক্রিকেটের ন্যায় সুবিধা, অনেক ম্যাচ খেলার সুযোগ আর সুন্দর মাঠ থাকতো তবে?

Sir Donald George Bradman 3

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ গড়ধারী তিনি। ২৩৪ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে সংগ্রহ ৯৫.১৪ গড়ে ২৮০৬৭ রান। ৫০ রান পেরিয়েছেন ১৮৬ বার, যার ১১৭ বারই ছুঁয়েছেন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কমপক্ষে ৫০ ইনিংস ব্যাট করেছেন এমন ব্যাটারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় ভারতের বিজয় মার্চেন্টের (৭১.৬৪)।

উত্থান পতন তো সবার জীবনেই আসে। ব্রাডম্যানও এর বাইরে নয়। তার ক্যারিয়ারেও খারাপ সময় দেখা দিয়েছিলো। বলা যায় সেবার ইংল্যান্ডের চাতুর্য কাজে লেগেছিলো। ব্রাডম্যানকে আটকাতে তাদের উদ্ভাবনী বডিলাইন সিরিজ ব্রাডম্যানকে পুরোপুরি ঘায়েল করেছিলে। পুরো ক্যারিয়ারে ওই একটা সময়ই ব্যর্থ হন ব্রাডম্যান। সেই সিরিজে ব্র্যাডম্যানের গড় ছিল মাত্র ৫৬.৫৭! অবাক হলেও এটাই সত্য।

অথচ ন্যূনতম ১০০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটারদের তালিকা করলে এই মুহূর্তে ব্রাডম্যানের পর সর্বোচ্চ গড় কামিন্দু মেন্ডিসের। শ্রীলঙ্কান এই ব্যাটার ২৪ ইনিংসে করেছেন ১৩১৬ রান। আর গড় ৬২.৬৬। যা ব্রাডম্যানের খারাপ সময়ের গড় থেকে মাত্র ৬ বেশি।

১৯০৮ সালের ২৭ আগস্ট নিউ সাউথ ওয়েলসে, বাবা জর্জ ব্রাডম্যান ও মা এমেলি ব্রাডম্যানের ঘর আলোকিত জন্ম হয় স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্রাডম্যানের। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ডন ব্রাডম্যান ছিলেন কনিষ্টতম।

ছোট থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছিল ব্রাডম্যানের। তিনি যে স্কুলে পড়তেন, তার মাঠে খেলতেন বড়রা। ধুলোভরা সেই মাঠে খড়ি দিয়ে বানানো হতো উইকেট। গাম গাছের ডালে তৈরি ব্যাট, প্যাডের বালাই নেই। সেদিকে কারো ‘থোড়াই কেয়ার’।

Sir Donald George Bradman2

স্কুলের বড় ভাইদের বদান্যতায় ধুলোভরা সেই মাঠে কালেভদ্রে ব্যাট ধরার সুযোগ মিলত ডোনাল্ডের। সেই ধারাবাহিকতায় প্রথমবার ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেন ডোনাল্ড, বয়স তখন ১১।

টস জিতে ডোনাল্ডদের দল ব্যাটিংয়ে। প্রতিপক্ষের এক বাঁহাতি বোলারের প্রথম দুই বলেই নেই দুই উইকেট। হ্যাটট্রিক বলের সামনে ব্যাট হাতে ডোনাল্ড। বলটা কিভাবে যেন আটকে দিলো ১১ বছর বয়সী কিশোর, পরে আউট হলো ৫০ রান করে। সেখান থেকেই শুরু।

ডোনাল্ডের মামা জর্জ হোয়াইটম্যান। স্থানীয় দল বাউরাল ক্রিকেটের অধিনায়ক তিনিই। তবে তাদের খেলায় ব্রাডম্যানের ভূমিকা ছিল স্কোরারের। একদিন সুযোগ মিলল ব্যাট করার। তখনো ফুলপ্যান্ট পরা হয়নি ডোনাল্ডের। ব্যাট প্রায় নিজের উচ্চতার সমান!

তাতে কী আসে যায়! মাথা ছুঁইছুঁই সেই ব্যাট দিয়ে রান করল ৩৭*। পরের শনিবারে আবারো সুযোগ এলো ব্যাটিংয়ের। এবার স্কোর ৩৯*।

এমন সাহসী দুটো ইনিংস মুগ্ধ করে তারই সিনিয়র এক সতীর্থ মি. সিড কিউপিট। একটা পুরনো ব্যাট উপহার দেন তিনি। তবে ব্যাটের এক জায়গায় ফাটল ছিল। তবে ব্রাডম্যানের বাবা জর্জ সেই ব্যাটটা খানিকটা কেটে দেন, তাতে কিছুটা হলেও কমে ব্যাটের উচ্চতা ও ওজন।

বানা জর্জ ছিলেন বেসগ ক্রিকেট পাগল। গ্যালারিতে বসে দেখতেন দেশের খেলা। সেবার ইংল্যান্ড গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে। সফরের পাঁচ নম্বর টেস্টটা ছিল সিডনিতে। সেই টেস্ট দেখতে যাচ্ছিলেন জর্জ, তার সাথে যাওয়ার কঠিন বায়না ধরেছিল ডোনাল্ড।

অনেক অনুরোধ-অনুনয়ের পর বাবা জর্জের মন গলে। গ্যালারিতে বসে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের স্বাদ নেয়া সেই প্রথম। প্রথম দুই দিনের খেলা দেখে বাড়ি ফেরেন বাবা-ছেলে। ফেরার সময় ডোনাল্ড তার বাবাকে বলে বসে, ‘এই মাঠে না খেলা পর্যন্ত আমার শান্তি হচ্ছে না।’

জর্জ তো তখনো জানতেন না, এই মাঠেই তার ছোট ছেলেটা দুটো সেঞ্চুরি, দুটো ফিফটি আর একটা ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকাবে!

যাহোক, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে অ্যাডিলেড ওভালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক তার। অভিষেকেই ১১৮ রানের ইনিংস খেলার পথে তার প্রতিভার জ্বলন্ত প্রমাণ রাখেন।

ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতিতে ১৯২৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় ব্রাডম্যানের। কিন্তু নিজেকে প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় দল থেকে বাদ পড়েন। ফেরেন এক ম্যাচ পরেই, সঙ্গী ‘ইতিহাস।’

তবে ডনকে ডন রূপে দেখা যায় ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড সফরে। সেবার সব ম্যাচ মিলিয়ে ৬টি দ্বি-শতকসহ, ১০টি শতক এবং ১৫টি অর্ধশতক তার। ওই এক সফর শেষেই ৯৮.৬৬ গড়ে তার রান দাঁড়ায় ৩০০০। ক্যারিয়ার শেষে যা দাঁড়ায় ৫২ টেস্টের ৮০ ইনিংসে ৯৯.৯৪ গড়ে ৬৯৯৬ রান।

সেই ৮০ টেস্ট ইনিংসের ১০টিতেই আবার অপরাজিত তিনি। সময়ের সর্বোচ্চ ২৯টি শতকও তখন তার। দুটো ত্রি-শতকের কীর্তিটাও তখন শুধুই তার। অবাহ্য এখন তাতে ভাগ বসিয়েছে আরো তিনজন। তবে সর্বোচ্চ ১২টি দ্বি-শতকের কীর্তিটা আজো একমাত্র তারই দখলে।

Sir Donald George Bradman 4

ব্যাট হাতে রানের বন্যা বইয়ে দিলেও ছক্কা মারতে কিছুটা কৃপণই ছিলেন স্যার ডন। ক্যারিয়ারে ৬১৮টা চার হাঁকালেও ব্র্যাডম্যানের উইলো থেকে এসেছিল কেবল ৬টি ছক্কা, যার ৫টিই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, একটি ভারতের বিরুদ্ধে।

ব্রাডম্যান সম্পর্কে বলতে গেলে ফুরোবে না। কীর্তির উত্তাল স্রোতে ভেসে যেতে হবে দূর অজানায়। উদাহরণ– ব্র্যাডম্যান থেকে ‘স্যার ব্র্যাডম্যান’ হওয়া। ১৯৪৯ সালে ক্রিকেটে ভূমিকার জন্য তাকে নাইটহুড দেয়া হয়।

একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ‘Wisden leading cricketer of the year’ এর পুরস্কার পান ১০ বার। উইজডেনের গত শতাব্দীর সেরা পাঁচজন ক্রিকেটার নির্বাচনে ১০০ জন বিচারকের ১০০টি ভোটই যায় ব্রাডম্যানের ঝুলিতে।

তা যাইহোক, আপনার মনে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, হালের মারপিটে ক্রিকেটে ব্রাডম্যান কি তার ডনগিরি বজায় রাখতে পারতেন? উত্তর জানাবো দুইভাবে। প্রথমটা, কাজে-কলমে। দ্বিতীয়টা, ব্রাডম্যানের সুরে।

প্রথম উত্তর হলো- ডি ভিলিয়ার্স ৩১ বলে দ্রুততম সেঞ্চুরি করেছেন, ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান বলে বিবেচিত গেইল ঘরোয়া ক্রিকেট ৩০ বলে সেঞ্চুরিও হাঁকিয়েছেন। তবুও তারা ব্রাডম্যানকে পেছনে ফেলতে পারেননি। ১৯৩১ সালে একটি ম্যাচে ব্র্যাডম্যান শতক ছুঁয়েছেন মাত্র ২২ বলে, ১৮ মিনিটে! তা ছাড়া সর্বোচ্চ ছয়বার এক সেশনে শতক স্পর্শের কীর্তিও তার। আছে টেস্টে মাত্র একদিনে ট্রিপল সেঞ্চুরির মাইলফলকও।

দ্বিতীয় উত্তর হলো- একবার এক অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক ব্র্যাডম্যানকে প্রশ্ন করেন, বর্তমান যুগে খেললে তার গড় কত হতো? ব্র্যাডম্যান সহাস্যে জবাব দেন, ৭০। সাংবাদিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আরো বেশি কেনো নয়? ব্র্যাডম্যানের পাল্টা প্রশ্ন ছিলো– ‘একজন ৮০ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের জন্য এটাই যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স নয় কী?’

চলুন একটা গল্প শুনি এবার– ব্রাডম্যানের ক্রিকেট ছাড়ার প্রায় ৪০ বছর পরের ঘটনা সেটি। ১৯৮৬ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা তখন কেপটাউনে কারাগারে বন্দী। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কারাগারে যখন তার সাথে দেখা করতে যান, মান্ডেলার প্রথম প্রশ্নটাই ছিল – ‘ব্র্যাডম্যান কি এখনো জীবিত আছেন?’

Sir-Donald-George-Bradman-5555

হ্যাঁ! ব্রাডম্যান তখনো স্ব-শরীরেই বেঁচে ছিলেন। তবে ২০০১ সালে দেহকে বিদায় বলে স্থান নেন, মানুষের প্রাণে-স্পন্দনে; ইতিহাসের অমরত্বে।

বাইশ গজে নব্বইয়ের ঘরে কখনোই উইকেট না দেয়া ব্রাডম্যান, নব্বইয়ের ঘরে উইকেট দিয়েছেন জীবনের খেলা ঘরে। শতক হতে মাত্র আট বছর দূরে থাকতে ৯২ বছর বয়সেই যে শেষ হয় ব্র্যাডম্যানের জীবনের ‘ইনিংস’।