ডব্লিউ জি গ্রেস : ক্রিকেটের প্রথম মেগাস্টার

ক্রিকেটের প্রথম এই মেগাস্টার ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে বিদায় জানান সবধরনের খেলা থেকে।

আফ্ফান উসামা
উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস
উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস |সংগৃহীত

‘ছোকরা, লোকজন নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার বোলিং নয়।’

ধেয়ে আসা বলটা প্রতিহত করতে ব্যর্থ, স্টাম্প ছত্রখান। তবুও বাইশ গজে দাঁড়িয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলটা বোলারের কাছে পাঠিয়ে উচ্চস্বরে এভাবেই বলে উঠলেন, ক্রিকেট ইতিহাসে ‘পিতামহ’ খ্যাত ডব্লিউ জি গ্রেস।

না! একবিন্দু মিথ্যে বলেননি গ্রেস। ইতিহাস বলে সেই সময়ে ব্রিটিশ মুলুকে তখনকার রানীর পর দ্বিতীয় জনপ্রিয় ব্যক্তিটিই গ্রেস। তিনি যে ম্যাচে খেলতেন সেই ম্যাচের আয়ের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি।

এমনকি শুধু গ্রেস খেলবেন বলে আয়োজকরা টিকেটের মূল্য দিত বাড়িয়ে। কিন্তু তবুও শুধুই তার ব্যাটিং উপভোগের উদ্দেশে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে চলে আসতো মাঠ-প্রাঙ্গণে। ভিড় জমে যেত আশপাশের রাস্তাতেও।

ডব্লিউ জি গ্রেসকে বলা হয়, আধুনিক ক্রিকেটের ‘পিতামহ।’ ক্রিকেটের প্রতি তার নিবেদন, ক্রিকেটে তার অবদান আর পরিসংখ্যান গ্রেসের পক্ষেই কথা বলে। ডব্লিউ জি গ্রেস যেন ক্রিকেটেরই একটা অধ্যায়।

ডন ব্র্যাডম্যান, ইয়ান বোথাম, সোবার্স, শচীনরা যদি ক্রিকেটের সেরা ছাত্র হয়ে থাকেন তাহলে সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নাম স্যার ডব্লিউ জি গ্রেস। অথচ দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই।

স্থূল শরীর আর বিশাল বাহু। কোমরের বেল্ট দিয়ে কোনো রকমে সামলে রাখতেন অবাধ্য ভুঁড়িটাকে। ঘন গোঁফে ঢাকা ঠোঁট আর বুকের নিচ পর্যন্ত ঝুলে থাকা লম্বা পাঁকা দাড়ি; ক্রিকেটের সাথে যায় কী। এমন অবয়ব আর যাই হোক ক্রিকেটারের হওয়ার কথা নয় নিশ্চয়ই!

তবে এই শরীর নিয়েও ব্যাট হাতে রাজত্ব করতেন গ্রেস। যদিও ক্যারিয়ারে মাত্র ২২টি টেস্ট খেলেছেন। কিন্তু তখনকার সময়ে এটা নিছক কোনো সংখ্যা নয়। তখন ক্রিকেট প্রসিদ্ধ ছিল না মোটেও। তবুও আবার একটা ম্যাচ খেলতে জাহাজে চেপে যেতে হতো হাজার মাইল পথ।

সব মিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৮৭০ ম্যাচে খেলে ৫৪ হাজার ২১১ রান করেন গ্রেস। ২ হাজার ৮০০ এরও বেশি উইকেট আর ৮৭০টির অধিক নিয়েছেন ক্যাচ। ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বপ্রথম সেঞ্চুরিরও মালিকও গ্রেস।

যদিও গ্রেসদের পরিসংখ্যানে বুঝানো যায় না, তাদের কখনো পরিমাপ করা যায় না। ক্রিকেটের নানান কৌশলগত দিক উদ্ভাবনে তার প্রভাব ছিল অনেক। এমনকি ক্রিকেটের অনেক আইনও তৈরি হয়েছে তার নির্দেশেই।

১৮৪৮ সালের ১৮ জুলাই ব্রিস্টলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম, উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস। পারিবারিক প্রথা মেনে চিকিৎসা পেশা বেছে নিলেও ডাক্তার গ্রেসের ধ্যান-জ্ঞানের বেশিভাগটা জুড়ে ছিল বাইশ গজ।

গ্রেস ছিলেন ক্রিকেটের চেয়েও বড়। নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রানির পর সম্ভবত তিনিই ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। নিজের জনপ্রিয়তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার তিনি করেছিলেন।

কথিত আছে নিজের হানিমুনও তিনি স্পন্সরের টাকায় করেছিলেন! ১৮৭৩-৭৪ মৌসুমে ক্রিকেট খেলার জন্য একটি দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে যাবার সময় সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আমলে যা ছিল একেবারেই অকল্পনীয়।

খেলার মাঠে তিনি যা বলতেন সেটাই আইন ছিল। এমনকি গ্রেসের ‘স্বৈরশাসক’ মূলক আচরণের কারণে অনেক কেচ্ছা-কাহিনীও চালু হয়ে যায়। লেখা শুরু করেছিলাম তেমনি একটা মজার গল্প দিয়ে।

গম্ভীর চেহারার এ ক্রিকেটারকে ঘিরে এমন আরো অনেক চমকপ্রদ কাহিনীর জনশ্রুতি আছে। যদিও এসব কাহিনীর সত্যতা যাচাই করা যায় না। তবে যুগ যুগ ধরে তা চলে আসছে ক্রিকেট ইতিহাসের সাথে সাথে।

এই যেমন, একবার ডব্লিউ জি গ্রেস ৯৯ রানে ব্যাট করছেন। বোলার যখন বল ছুড়লেন তিনি স্ট্যাম্প থেকে সরে গেলেন। ফলাফল বোল্ড আউট। সতীর্থ খেলোয়াড়েরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এ কাজ করলে কেন? গ্রেসের জবাব, আমি ৮২টা সেঞ্চুরি করেছি কিন্তু কখনো ৯৯ রানে আউট হইনি। তাই ৯৯ রানে আউট হয়ে দেখলাম কেমন লাগে।

আরেকবার নাকি তিনি যখন ৯৩ রানে ব্যাটিং করছেন, তখনই তিনি ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন। এমন করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ০ থেকে ১০০ সব রানই করেছি, কিন্তু ৯৩ কখনই করিনি। সেই জন্যই আজ এমন কাজ করেছি।

আরেকটা অদ্ভুত ঘটনাও শোনা যায়। সালটা তখন নাকি ১৮৭৬। গ্রেস তার সেরা ফর্মে। তাকে থামাতে তাই এক ম্যাচে ১১ -এর বিরুদ্ধে ২২ জনের দল গড়া হলো। গ্রেস সাহেব তাতেই রাজী। তার কোনোকিছুতেই সমস্যা নেই। তিনি ২২ জনের বিরুদ্ধেই ব্যাট হাতে নেমে পড়লেন।

বাইশ ফিল্ডারদের এড়িয়ে তার শট ছুটতে লাগলো। রান আর রান। ফ্রন্ট আর ব্যাকফুট দুটোতেই তিনি শট খেলতেন। বাইশ জনের মাঝেও তিনি ঠিক ফাঁক খুঁজে নিতে লাগলেন। ভাবুন কী কাণ্ড।

তবে অবাক হবার এখনো বাকি। বাইশ জন ফিল্ডারের বিরুদ্ধে সেবার কত রান করেছিলেন জানেন? ৪০০। তবে বিপক্ষ দল গ্রিমসবীর দাবি যে- ওটা ৩৯৯ ছিল। কথিত আছে, গ্রেস স্কোরারকে জোর করে বাধ্য করেছিলেন ৪০০ লিখতে।

আরেকবার গ্রেস প্রথম বলে আউট হয়ে গেলেন। সাথে সাথেই জি গ্রেস বলে উঠেন, ‘ট্রায়াল বল হিসেবে ভালোই ছিল। এবার তবে খেলা শুরু করা যাক।’

তবে সব থেকে মজার যেই গল্প প্রচলিত আছে, তা হলো- ‘একবার গ্রেসের বিপক্ষে একটাও লেগ-বিফোর আবেদন গ্রাহ্য করছিলেন না আম্পায়ার। প্রচণ্ড হতাশ ও রাগন্বিত বোলার বোল্ডই করে বসলেন গ্রেসকে। তাতে দুটি স্ট্যাম্প দু’দিকে উপড়ে পড়ে।’

বোলার তখন রসিকতা করে বলে উঠেন, ’এখনো একটা স্ট্যাম্প দাঁড়িয়ে আছে। তুমি নিশ্চয়ই যাবে না, ডক্টর?’ মুচকি হেসে গ্রেস কী উত্তর দেন, ‘এতে আর আশ্চর্য্যের কী আছে।’ অতঃপর আবার ব্যাটিং করতে দাঁড়িয়ে গেলেন জি গ্রেস।

একদিন নাকি আউট হয়ে যাওয়ার পর জি গ্রেস আম্পায়ারের কাছে গিয়ে বলছিলেন, ‘আসলে বাতাস একটু জোরে হওয়ায় বেলটা পড়ে গেল’। আম্পায়ারও জবাবে বলেছিলেন ‘বাতাসটা আরেকটু জোরে হলে তোমালে ড্রেসিংরুমে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারবে।’

বল হাতেও রসিক ছিলেন গ্রেস। সূর্যের দিকে তাকিয়ে ব্যাটসম্যানকে বলতেন ‘আকাশে কত পাখি উড়ে যাচ্ছে, দেখো।’ ব্যাটসম্যান তাকাতো, যার ফলে তার চোখে ধাঁধা লেগে যেতো। সেই সুযোগে গ্রেস তাকে আউট করে দিত।

ক্রিকেটের প্রথম এই মেগাস্টার ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে বিদায় জানান সবধরনের খেলা থেকে। পরের বছর ১৯১৫ সালের ২৩ অক্টোবর মটিংহ্যাম কেন্টে তিনি ৬৭ বছর ৯৭ দিন বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।