কতদূর গড়াবে সাকিব ও আসিফ মাহমুদের বাদানুবাদ

‘ক্যারিয়ার জুড়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে একের পর এক বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন সাকিব, কখনো গ্যালারিতে মারমুখী অবস্থায় দেখা গেছে, কখনো টিভি ক্যামেরায় অসঙ্গত অঙ্গভঙ্গি করে শাস্তি পেয়েছেন।’

নয়া দিগন্ত অনলাইন
সাকিব আল হাসান ও আসিফ মাহমুদ
সাকিব আল হাসান ও আসিফ মাহমুদ |সংগৃহীত

সাকিব আল হাসান ও আসিফ মাহমুদের মধ্যে চলছে একটা কথার লড়াই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু এই বাদানুবাদ। এরপর মূলধারার গণমাধ্যমে দুজন কথা বলে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেন, সাকিব আল হাসান যাতে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে আর খেলতে না পারেন সেই নির্দেশনা দেয়া হবে।

আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে অনেকেই জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময়ে নীরব থাকার অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকে বলছেন- সাকিব যদি অপরাধ করে থাকে তবে তার বিচার হওয়া উচিৎ, কিন্তু জাতীয় দল থেকে দূরে রাখা উচিৎ নয়।

আবার সাকিব আল হাসান চাইলে আদালত পর্যন্ত যেতে পারেন বলছেন বিশ্লেষকরা।

তবে চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য যেখানে দেশের বাইরেই আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খেলোয়াড় স্ট্যাটাসের কারণে এই বিবেচনা শিথিল হবে বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা।

ক্রিকেট সাংবাদিক মাজহারুল ইসলাম জানান, যা হচ্ছে তা প্রত্যাশিত না, তবে এখানে ক্রিকেট মুখ্য ইস্যু না। সাকিব যেটার মুখোমুখি হচ্ছে সেটা রাজনৈতিক বাস্তবতা।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে এক বোর্ড কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মিডিয়ায় দেয়া বক্তব্য তো নির্দেশনা না, এমন কিছু আমাদের কাছে আসেনি। এলে আমরা বিবেচনা করে দেখবো।

তবে তিনি জানিয়েছেন, বয়স ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে সাকিবের বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

‘শুভ জন্মদিন আপা’ দিয়ে শুরু বিতর্ক
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত।

একমাত্র অলরাউন্ডার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের র‍্যাংকিংয়ের তিন ফরম্যাট টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে এক নম্বরে ছিলেন দীর্ঘদিন।

তবে ক্যারিয়ার জুড়ে মাঠে ও মাঠের বাইরে একের পর এক বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন সাকিব, কখনো গ্যালারিতে মারমুখী অবস্থায় দেখা গেছে, কখনো টিভি ক্যামেরায় অসঙ্গত অঙ্গভঙ্গি করে শাস্তি পেয়েছেন।

এ ছাড়া নিজের কাঁকড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে কর্মীদের বেতন না দেয়া থেকে শুরু করে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির মতো অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সাকিবের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হত্যা মামলা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলাও আছে, সম্পূরক তথ্য হচ্ছে- আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাকিব আল হাসান ছিলেন দুদকের শুভেচ্ছাদূত।

এবার তিনি জন্ম দিয়েছেন নতুন এক বিতর্কের, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন আপা।’

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান দমাতে শেখ হাসিনা মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে বলছে আদালত। সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে গেজেট তৈরি করেছে, তাতে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ৮৪৪ জন।

এমন এক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার জন্মদিনে সাকিব আল হাসানের শুভেচ্ছা অনেকেই ভালোভাবে নেননি।

তাদেরই একজন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, যিনি নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘একজনকে পুনর্বাসন না করায় সহস্র গালি খেয়েছি। আমি নির্বাচন করেছিলাম, রাজনীতিতে লিপ্ত হইনি।’

আসিফ মাহমুদের পোস্টের পর সাকিবও ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি লেখেন, ‘শেষমেশ কেউ একজন স্বীকার করে নিলেন, তার জন্যই আমার আর বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেয়া হলো না, বাংলাদেশকে খেলতে পারছিলাম না!’

আসিফ মাহমুদ পরে আরেকটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে খানিকটা শ্লেষ মাখা ভাষায় লেখেন, ‘ভাইয়া, আমাকে জোর করে নমিনেশন দেয়া হয়েছিল। আমি শুধু নির্বাচনটাই করেছিলাম, আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে জড়িত হইনি। ইউ নো হু।’

তিনি যোগ করেন, ‘যার হাত ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত, তাকে বাংলাদেশের পতাকা বহন করতে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বোর্ডের কর্তারা একাধিকবার রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে বললেও তা না করে বরং খুনিদের এনডোর্স করা ছাড়াও শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, মানি লন্ডারিং, ফিন্যান্সিয়াল ফ্রড করা কাউকে কেন শুধু ভালো ক্রিকেটার বলেই পুনর্বাসন করতে হবে? আইন সবার জন্য সমান, ফেস ইট।’

ঘটনার প্রেক্ষাপট কী?
অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সময় কানাডায় ছিলেন সাকিব আল হাসান। সেখানে তিনি একটি টি-২০ লিগে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর সাকিব আর দেশে ফিরতে পারেননি।

নৌকা প্রতীকে ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এটাকে তখনই ভালোভাবে নেননি অনেক ক্রিকেটপ্রেমী। এমনকি সাকিব আল হাসানকে পছন্দ করেন এমন অনেকেই তখন সাকিবের রাজনীতিতে জড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন।

অভ্যুত্থানের পর আরো অনেকের মতোই সাকিবের নাম জড়িয়ে যায় হত্যা মামলায়।

এ ছাড়া শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায়ও আছে সাকিবের বিরুদ্ধে।

গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশের বাইরে পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেললেও ঝামেলা শুরু হয় দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের সময়।

সময়টা সেপ্টেম্বর ২০২৪, সাকিব সংবাদ সম্মেলনে জানান, তিনি দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করতে চান।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সাকিব আল হাসানের বিদায়ী ম্যাচ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবেই রূপ নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে শেষ টেস্ট খেলার ইচ্ছা থাকলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি।

তখন সাকিব দেশে ফেরার আগে সরকারের কাছে নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন, যেন ম্যাচ শেষে তিনি নিরাপদে যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারে ফিরতে পারেন। তবে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্পষ্ট করে দেন, ‘খেলোয়াড় সাকিবের নিরাপত্তা নিশ্চিত আছে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে জনমনে তৈরি হওয়া ক্রোধের বিপরীতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাওয়াটা অবান্তর।’

এমন অবস্থায় বিসিবির তখনকার সভাপতি ফারুক আহমেদ জানিয়ে দেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব নয়, সরকারের কাজ।

আর বিসিবি পরিচালক ও সাকিবের দীর্ঘদিনের কোচ নাজমূল আবেদীনও তখন মন্তব্য করেছিলেন, ঘরের মাঠে সাকিবের শেষ টেস্ট খেলার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

পরে সরকার এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায়, কানপুরে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচই থেকে যায় সাকিব আল হাসানের শেষ টেস্ট।

দলের সাথে যোগ দিতে দুবাই হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় মাঝপথ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে হয় তাকে।

তখনই নানা বক্তব্য ও পরিস্থিতির সূত্র ধরে ধারণা করা হয়েছিল, সাকিবকে দেশে ফেরার সুযোগ না দেয়ার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ক্রীড়া উপদেষ্টার।

সেই ধারণার সত্যতা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি আসিফ মাহমুদের ফেসবুক স্ট্যাটাসে।

তার লেখা- ‘একজনকে পুনর্বাসন না করা’ আসলে সাকিবকেই ইঙ্গিত করে বলা।

সাকিবও যে সেটাই বুঝেছেন, তা বোঝা যায় তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায়। বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘যাক, শেষমেশ কেউ একজন স্বীকার করে নিলেন যে তার জন্যই আমার আর বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেয়া হলো না, বাংলাদেশের জন্য খেলতে পারলাম না!’

স্ট্যাটাসের শেষে তিনি যোগ করেন, ‘ফিরব হয়তো কোনো দিন আপন মাতৃভূমিতে, ভালোবাসি বাংলাদেশ।’

আইসিসির কিছু করণীয় আছে?
একটা বোর্ডের দল নির্বাচনে সরকার পক্ষের হস্তক্ষেপ কি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের রোষানলে ফেলতে পারে?

বাংলাদেশের জ্যেষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক এম এম কায়সার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যেভাবে ক্রীড়া উপদেষ্টা একজন ক্রিকেটারকে না খেলানোর কথা বলছেন তা ভালো উদাহরণ না, তবে আইসিসির এক্ষেত্রে তেমন কোনো কিছু করার থাকবে না। প্রত্যেক ক্রিকেটার তার দেশের সংশ্লিষ্ট বোর্ড কর্তৃক নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হবে।’

তবে সাকিব চাইলে আদালতে যেতে পারেন, যোগ করেন এম এম কায়সার। তাকে দলে না নিলে এই ক্ষেত্রে আইসিসির কিছুই করার নেই বলছেন তিনি। সূত্র : বিবিসি