দরিদ্রতাকে ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক হকিতেও মাঠ কাঁপাচ্ছে কনা

চীনের ওই এশিয়া কাপ হকিতে সাত ম্যাচের মধ্যে দু’টিতে ম্যান অফ দ্যা প্লেয়ার নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি সিঙ্গাপুর ও ওমানে দু’বার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

মো: আব্দুল আওয়াল, বাগাতিপাড়া (নাটোর)

Location :

Bagatipara
কনা খাতুন
কনা খাতুন |নয়া দিগন্ত

নাটোরের বাগাতিপাড়া গ্রামের দিনমজুর বাবার মেয়ে কনা খাতুন দেশের বাহিরে আন্তর্জাতিক হকিতেও এখন বাংলাদেশের হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছে। সম্প্রতি চীনের দাজহুতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপ হকিতে দেশের হয়ে খেলে গ্রামের বাড়িতে এসেছে।

চীনের ওই এশিয়া কাপ হকিতে সাত ম্যাচের মধ্যে দু’টিতে ম্যান অফ দ্যা প্লেয়ার নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি সিঙ্গাপুর ও ওমানে দু’বার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে।

এতকিছুর পরও দরিদ্রতা কনাকে সবসময়ই পিছুটানছে। কনার মা জানিয়েছেন, বিকেসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) কনার এখনো ১২ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। বকেয়ার অর্থ জোগান দেয়া তাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, কনা উপজেলার ফাগুয়াড়দিয়াড় ইউনিয়নের সান্যালপাড়া গ্রামের দিনমজুর আবু বক্করের মেয়ে। ছোট একটুকরো বাড়ির ভিটা এবং টিনের ছাউনির এক ছোট্ট ঘরই তাদের সম্বল। কনার বাবার দিনমজুরের কষ্টের আয়ে চলে ছয় সদস্যের সংসার।

কনার মেজো বোন বিনাও অসাধারণ ফুটবল খেলত। স্কুল জীবনেই জেলা পেরিয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় কনাও তার বোনের সাথে স্থানীয় মাঠে খেলায় অংশ নিতেন। তখনই খেলার নেশা তার উপরে চেপে বসে। কিন্তু বেশিদিন তার বোন টিকতে পারেনি। আর্থিক টানাপোড়েনে অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেয় তার পরিবার। এরপর সে একা হয়ে পড়লেও খেলা ছাড়ে না। শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে যখন পুরো গ্রামের মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন কনা ছুটে যেতেন মাঠে।

বাবা-মা জানলে খেলায় বাধা দেবে, এই ভয়ে লুকিয়ে স্থানীয় সান্যালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে অনুশীলন করত। কনা উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেছে। তার এই কৃতিত্ব ও খেলার প্রতি এমন আগ্রহ দেখে তার পাশে দাঁড়ায় স্থানীয় স্কুল শিক্ষক কামরুল হাসান। সকল সহযোগিতার পাশাপাশি দেন অনুপ্রেরণা।

২০২১ সালে শিক্ষক কামরুল হাসানের উদ্যোগে রাজশাহীতে বিকেসপির ট্রায়ালে অংশ নেয় কনা। সেখানে হকি, জিমন্যাস্টিকস ও ফুটবলে অংশ নেয়। একসাথে সে তিনটি খেলাতেই নির্বাচিত হয়। হকি এবং জিমন্যাস্টিকস এ প্রথম হয় এবং ফুটবলে হয় ২৩তম। তখন তিনি শিক্ষক কামরুল হাসানের পরামর্শে বেছে নেন হকি। শুরু হয় কনার নতুন সংগ্রাম।

এদিকে মেয়ের বিকেএসপিতে সুযোগের খবরে পরিবার খুশি হলেও সেই সাথে পড়ে দুশ্চিন্তায়। সেখানে ভর্তির জন্য প্রয়োজন হয় ৩৫ হাজার টাকা। কনার পরিবারের জন্য এত টাকা জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন শিক্ষক কামরুল হাসানের সহায়তা ও পরিবারের শেষ সম্বল ছাগল ও হাঁস বিক্রি করে কনা ভর্তি হয় বিকেএসপিতে। সেই ছোট্ট গ্রাম থেকে পা রাখে ক্রীড়া শিক্ষার মূল স্রোতে।

বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার দু’বছর পরই অনূর্ধ্ব ২১ দলের হয়ে এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপ জুনিয়র টুর্নামেন্ট খেলতে দেশের বাইরে যায় কনা। এরপর ২০২৪ সালে সিঙ্গাপুর ও ওমানে গিয়ে আরো দু’বার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। সবশেষ ২০২৫ সালে চীনের দাজহুতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপ হকিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। কনাও দলে জায়গা করে নেয়। সাতটি ম্যাচে অংশ নিয়ে দু’টিতে ম্যান অফ দ্যা প্লেয়াার নির্বাচিত হয় দলের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়।

কনার মা চামেলী বেগম বলেন, সমাজের মানুষের অনেক কটু কথা শুনেছি। সবাই বলত, মেয়ে খেলা শিখে কী করবে? অনেকবার বাধা দিয়েছি। কিন্তু মেয়েকে আটকে রাখতে পারিনি। অর্থের সঙ্কট, সামাজিক বাধা সত্ত্বেও মেয়ের ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমে আজকে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। ভবিষ্যতে আরো ভালো খেলার মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে দেশের সুনাম অর্জন করবে এমনটা কামনা মায়ের।

শিক্ষক কামরুল হাসান বলেন, এই মেয়েটির মধ্যে নিষ্ঠা ও চেষ্টা ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি শুধু একটু পথ দেখিয়ে দিতে। ওর অর্জন আমাদের সবার সম্মিলিত স্বপ্নের ফসল। তবে ওদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সে ভালো মানের খেলোয়াড় হতে পারবে।

নিজের স্বপ্ন নিয়ে কনা জানায়, দেশের হয়ে খেলতে পারাটা অনেক বড় সম্মানের। আমি চাই আরো ভালো খেলতে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করতে। আগামীর এই পথচলা তার যেন থেমে না যায় সেজন্য সকলের কাছে দোয়া কামনা করি।