প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ফোন হ্যাক, ডেটা চুরি বা ভাইরাস আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। আপনার স্মার্টফোনে এখন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ব্যক্তিগত ছবি, পরিবারের তথ্য, অফিসের গোপনীয় ডকুমেন্ট সবকিছুই আছে। কিন্তু মোবাইল ভাইরাস এবং ম্যালওয়্যার থেকে কতটা সুরক্ষিত আপনার ফোন? আসুন জেনে নিই কীভাবে আপনার ফোনকে সুরক্ষিত রাখবেন।
শুধু বিশ্বস্ত উৎস থেকে অ্যাপ ইনস্টল করা
ভাইরাস প্রবেশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো আন অথোরাইজড অ্যাপস। সবসময় Google Play Store বা Apple App Store থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করুন। থার্ড পার্টির ওয়েবসাইট থেকে APK ফাইল ডাউনলোড করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ফাইলে লুকিয়ে থাকতে পারে ম্যালওয়্যার যা আপনার সব ডেটা চুরি করে নিতে সক্ষম।

এমনকি গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করার সময়ও সতর্ক থাকুন। ডাউনলোড করার আগে অ্যাপের রিভিউ, রেটিং দেখুন, কত ডাউনলোড হয়েছে তা চেক করুন। অ্যাপ ডেভেলপারের নাম চিনতে না পারলে একটু রিসার্চ করুন। অনেক সময় জাল অ্যাপ জনপ্রিয় অ্যাপের নকল করে প্লাব্লিশড করা হয় এই ধরনের অ্যাপস থেকে সাবধান থাকতে হবে। বিশ্বস্ত মোবাইলের ওয়েবসাইট MobileMaya থেকে মোবাইলের তথ্য সংরহ করা হয়েছে।
অ্যাপ পারমিশনে সতর্কতা
অ্যাপ ইনস্টল করার সময় যে পারমিশনগুলো চায় সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। যদি এমন হয় যে একটা ক্যালকুলেটর অ্যাপ আপনার ক্যামেরা, মাইক্রোফোন বা কন্টাক্ট লিস্ট অ্যাক্সেস এর মতো অপ্রয়োজনীয় পারমিশন চাইছে তাৎক্ষনিক সেই অ্যাপ ইনস্টল করা থেকে বিরত থাকুন।
ফোনের মধ্যে যেসব অ্যাপ ইতিমধ্যে ইনস্টল করা আছে, সেগুলোর পারমিশন চেক করুন। Settings > Apps > Permissions থেকে দেখতে পারবেন কোন অ্যাপ কী কী অ্যাক্সেস করতে পারছে। সেখান থেকে অপ্রয়োজনীয় পারমিশন বন্ধ করে দিন। বিশেষ করে লোকেশন, ক্যামেরা, মাইক্রোফোন এবং স্টোরেজ অ্যাক্সেস নিয়ে সতর্ক থাকুন।
নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট করা
অপারেটিং সিস্টেম এবং অ্যাপ আপডেট শুধু নতুন ফিচার আনে না, এগুলো সিকিউরিটির ঝমেলাও নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। তাই যখনই সিস্টেম আপডেট বা অ্যাপ আপডেট আসে, যত দ্রুত সম্ভব ইনস্টল করুন।ফোনের মধ্যে অটো-আপডেট চালু রাখতে পারেন যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট ইনস্টল হয়ে যায়। তবে মনে রাখবেন, আপডেট করার আগে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা ব্যাকআপ নিয়ে নিন। ম্যানুয়ালি আপডেট করতে ফলো করতে পারেন এই ধাপ সমূহ Android ফোনের জন্য Settings > System > System Update থেকে চেক করুন। iPhone ফোনের জন্য Settings > General > Software Update।

সন্দেহজনক লিংক এবং মেসেজ এড়িয়ে চলা
বর্তমান সময়ে ফিশিং অ্যাটাক এখন খুবই সাধারণ একটি বিষয়। SMS, WhatsApp, Facebook Messenger এর মাধ্যমে আসতে পারে প্রতারণামূলক লিংক বা কমেন্ট যেমন "আপনার অ্যাকাউন্ট ব্লক হয়ে গেছে, এই লিংকে ক্লিক করে ভেরিফাই করুন" - এ ধরনের মেসেজ পেলে সাবধান।
কোনো অচেনা নম্বর থেকে লিংক আসলে ক্লিক করবেন না। এমনকি চেনা মানুষের নাম থেকে এলেও প্রথমে তাকে ফোন করে কনফার্ম করুন যে সে আসলেই পাঠিয়েছে কিনা। ব্যাংক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা খুবই কমন। মনে রাখবেন, ব্যাংক কখনো SMS এ লিংক পাঠিয়ে পাসওয়ার্ড বা OTP চায় না।
শক্তিশালী পাসওয়ার্ড এবং বায়োমেট্রিক ব্যবহার
ফোনে স্ক্রিন লক না রাখা মানে সবার জন্য দরজা খোলা রাখা। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড, পিন বা প্যাটার্ন ব্যবহার করুন। সহজ পিন যেমন "1234" বা "0000" এর মতো পিন ব্যবহার করবেন না। জন্মতারিখ বা ফোন নম্বর দিয়েও পাসওয়ার্ড বানাবেন না হ্যাকাররা এগুলো সহজেই অনুমান করতে পারে।
সুরক্ষার জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফেস আনলক ব্যবহার করুন। এগুলো শুধু সুবিধাজনকই নয়, বেশি সিকিউরও। তবে পাসওয়ার্ড/পিন ব্যাকআপ হিসেবে রাখতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপগুলোতে আলাদা করে লক দিতে পারেন অ্যাপ লক ফিচার ব্যবহার করে।

পাবলিক Wi-Fi থেকে সাবধান
শপিং মল, রেস্তোরাঁ বা কফি শপের ফ্রি Wi-Fi খুবই আকর্ষণীয়, কিন্তু সেটা অনিরাপদ। হ্যাকাররা এসব নেটওয়ার্কে সহজেই আপনার ডেটা চুরি করতে পারে। পাবলিক Wi-Fi তে যুক্ত থাকলে ব্যাংকিং বা পেমেন্ট করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। যদি পাবলিক Wi-Fi ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে VPN ব্যবহার করা নিরাপদ বেশি। VPN আপনার ডেটা এনক্রিপ্ট করে রাখে যাতে কেউ চুরি করতে না পারে। বিশ্বস্ত VPN সার্ভিস ব্যবহার করতে হবে।
অ্যান্টিভাইরাসের ব্যবহার
Android ফোনে অ্যান্টিভাইরাস অ্যাপ নিয়ে বিতর্ক আছে। Google Play Protect ইতিমধ্যে বিল্ট-ইন সুরক্ষা দেয়। তবে অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য বিশ্বস্ত অ্যান্টিভাইরাস যেমন Malwarebytes, Avast Mobile Security, Bitdefender ব্যবহার করতে পারেন। iPhone এ অ্যান্টিভাইরাসের তেমন প্রয়োজন নেই কারণ iOS অনেক বেশি সিকিউর এবং ক্লোজড সিস্টেম। তবে জেইলব্রোকেন iPhone ব্যবহার করলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। মনে রাখবেন, অনেক "ফ্রি অ্যান্টিভাইরাস" অ্যাপ নিজেরাই ম্যালওয়ার। তাই শুধু বিশ্বস্ত এবং সুপরিচিত কোম্পানির অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন।

নিয়মিত ব্যাকআপ রাখা
ভাইরাস আক্রমণ হলে বা ফোন হারিয়ে গেলে ব্যাকআপ থাকলে আপনার ডেটা নিরাপদ। Google Photos তে ছবি-ভিডিও অটো ব্যাকআপ চালু রাখুন। গুরুত্বপূর্ণ ফাইল Google Drive, Dropbox বা OneDrive এ রাখুন। iPhone এর জন্য iCloud Backup ব্যবহার করুন। মাসে অন্তত একবার ম্যানুয়াল ব্যাকআপ নিন। মনে রাখবেন, ক্লাউডে ব্যাকআপ নেওয়ার সময় শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন এবং 2FA চালু রাখা বেশ নিরাপদ।
অব্যবহৃত অ্যাপ ডিলিট করা
আপনার ফোনে কতগুলো অ্যাপ আছে যেগুলো মাসে একবারও ব্যবহার করা হয় না, এসব অ্যাপ শুধু স্টোরেজই নষ্ট করে না বরং সিকিউরিটি রিস্কও তৈরি করে। পুরনো অ্যাপগুলো আপডেট হয় না, ফলে সেগুলোতে সিকিউরিটি হোল থাকে যা হ্যাকাররা কাজে লাগাতে পারে। নিয়মিত ফোন চেক করুন এবং অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ আনইনস্টল করুন। ব্রাউজার হিস্টরি, ক্যাশ এবং কুকিজ নিয়মিত ক্লিয়ার করুন। এতে পারফরম্যান্সও ভালো হবে, সিকিউরিটিও বাড়বে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত না শেয়ার করা
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করলে হ্যাকারদের কাজ সহজ হয়ে যায়। আপনার জন্মতারিখ, ঠিকানা, ফোন নম্বর, পরিবারের তথ্য এসব দিয়ে সোশ্যাল মিডীয়ায় অ্যাটাক করা হয়। এর জন্য প্রাইভেসি সেটিংস চেক করুন। কে আপনার পোস্ট দেখতে পারবে, কে ট্যাগ করতে পারবে এসব কন্ট্রোলে রাখা ভালো। অচেনা মানুষের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ না কড়াই ভালো। মনে রাখবেন, ইন্টারনেটে একবার কিছু পোস্ট করলে সেটা চিরকালের জন্য থেকে যেতে পারে।
শেষ কথা
মোবাইল ফোন সুরক্ষা রাখা কঠিন কিছু নয়, শুধু একটু সচেতনতা দরকার। প্রতিটা ক্লিকের আগে একটু ভাবুন। অ্যাপ ইনস্টল করার আগে যাচাই করুন পারমিশন চাইলে লক্ষ্য করুন যে এই এপসের জন্য এটা সত্যিই প্রয়োজন আছে কি না?
আপনার ফোন শুধু একটা ডিভাইস নয়, এটা আপনার ডিজিটাল জীবন। এর সুরক্ষা মানে আপনার টাকা, তথ্য, প্রাইভেসির সুরক্ষা। উপরের টিপসগুলো মেনে চললে আপনার ফোন থাকবে ভাইরাস এবং ম্যালওয়্যার থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন সহজেই।



