ভালো মানের স্মার্টফোন কেনার ইচ্ছা সবারই থাকে। ফ্ল্যাগশিপ ফোন নাকি বাজেট ফোন কোনটি কিনবেন তা নিয়ে দ্বিধায় পরেন? কিন্তু আসল স্মার্ট চয়েস হলো মিড রেঞ্জ স্মার্টফোন। ১৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে ফ্ল্যাগশিপের সকল ফোনগুলোতে প্রায় সব ফিচারই পাওয়া যায়, কিন্তু দাম থাকে সাধ্যের মধ্যে।
বাংলাদেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশিরভাগ এই রেঞ্জের ফোন ক্রয় করে থাকেন। তাই আজকে আমরা এখান থেকে জেনে নিতে পারবো যে মিড রেঞ্জের ফোন কেনার সময় কোন ফিচারগুলো অবশ্যই চেক করে মোবাইল ফোন কিনতে হবে। ফোনের বর্তমান দাম ও স্পেসিফিকেশন জানতে ভিজিট করতে পারেন MobileDokan এর ওয়েবসাইট।
১. প্রসেসর
প্রসেসর বা চিপসেট হলো ফোনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা সঠিক ভাবে কাজ না করলে বাকি সব ফিচার অকেজো। মিড রেঞ্জ ফোনের মধ্যে যে সকল প্রসেসর থাকা জরুরী তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য Qualcomm Snapdragon 7 সিরিজ, MediaTek Dimensity 7000 বা 8000 সিরিজ, অথবা Google Tensor চিপসেট ভালো পারফরম্যান্স দেয়।

একটা ভালো প্রসেসর মানে মাল্টিটাস্কিং এর জন্য স্মুথভাবে কাজ করে, গেমিং করতে ল্যাগ করবে না, ক্যামেরা দ্রুত ক্যাপাচার করবে এবং ব্যাটারির দীর্ঘ চার্জিং ব্যাকআপ দিবে। প্রসেসরের ন্যানোমিটার দেখুন যত কম (যেমন ৪nm বা ৬nm) তত ভালো এফিশিয়েন্সি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো AI প্রসেসিং ইউনিট বা NPU। আধুনিক চিপসেটে AI ফিচার থাকলে ক্যামেরা, ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট সব কিছুই আরও স্মার্টলি কাজ করবে।
২. RAM এবং স্টোরেজ
RAM হলো ফোনের শর্ট-টার্ম মেমোরি। RAM যত বেশি হবে, তত বেশি অ্যাপ একসাথে চালাতে সাহায্য করবে কোনো ল্যাগ ছাড়া। মিড রেঞ্জ ফোনে কমপক্ষে ৬GB RAM থাকা উচিত, তবে ৮GB হলে সবচেয়ে ভালো হয়। অনেক ফোনে ভার্চুয়াল RAM বা RAM এক্সপানশন ফিচার আছে যেটা স্টোরেজ থেকে ২-৩GB অতিরিক্ত RAM হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
মিড রেঞ্জ ফোনের স্টোরেজের ক্ষেত্রে ১২৮GB মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড হওয়া উচিত। তবে আজকালের হাই-রেজোলিউশন ফটো, ভিডিও এবং বড় সাইজের গেমস চিন্তা করলে ২৫৬GB স্টোরেজ ভালো হবে।
৩. ডিসপ্লে
আপনি ফোনের যেই অংশটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো ডিসপ্লে। তাই ভালো ডিসপ্লে অত্যন্ত জরুরি। মিড রেঞ্জ ফোনে এখন AMOLED বা Super AMOLED ডিসপ্লে কমন হয়ে গেছে। AMOLED এর সুবিধা হলো গভীর কালো রঙ, উজ্জ্বল রঙ, কম পাওয়ার ব্যবহার এবং চমৎকার কন্ট্রাস্ট প্রদান করে থাকে। ফোনের রেজোলিউশন কমপক্ষে 1080 x 2400 পিক্সেল হওয়া উচিত। এর কম হলে ছবি, ভিডিও ভালো দেখা যাবে না। রিফ্রেশ রেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার সেক্ষেত্রে ৯০Hz বা ১২০Hz রিফ্রেশ রেট থাকলে স্ক্রলিং, অ্যানিমেশন সবকিছু অনেক স্মুথলি ব্যবহার করা যায়।

ব্রাইটনেস লেভেল কমপক্ষে ৫০০ nits থাকা উচিত যাতে রোদে ভালো দেখা যায়। পিক ব্রাইটনেস ১০০০+ nits হলে আরও ভালো। কর্নিং গরিলা গ্লাস ভিক্টাস বা গরিলা গ্লাস ৫ প্রটেকশন থাকলে স্ক্রিন আঁচড় এবং ফেটে যাওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে।
৪. ক্যামেরা
চাহিদার দিক থেকে ক্যামেরা বোধহয় মিড রেঞ্জ ফোনের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত ফিচার। শুধু মেগাপিক্সেল দেখে বিভ্রান্ত না হয়ে সেন্সর কোয়ালিটি দেখা উচিৎ। একটা ৫০MP ক্যামেরা সব সময় একটা ১০৮MP ক্যামেরার চেয়ে ভালো ছবি তুলতে পারে যদি সেন্সর কোয়ালিটি ভালো হয়।
মেইন ক্যামেরা সেন্সর দেখুন Sony IMX, Samsung ISOCELL GN বা Samsung HM সিরিজ ভালো। সেন্সর সাইজ গুরুত্বপূর্ণ ১/১.৫৬" বা তার চেয়ে বড় হলে লো-লাইটে ভালো পারফরম্যান্স পাবেন। OIS থাকলে ভিডিও এবং লো-লাইট ফটো আরও শার্প হবে।

আলট্রা-ওয়াইড ক্যামেরা (১১৮-১২০ ডিগ্রি) থাকা উচিত। কারণ গ্রুপ ফটো এবং ল্যান্ডস্কেপের জন্য সাধারণ এটি ব্যবহারের প্রয়োজন পরে। ম্যাক্রো ক্যামেরা বেশিরভাগ সময়ই মার্কেটিং গিমিক ২MP ম্যাক্রোর চেয়ে ভালো মেইন ক্যামেরার ডিজিটাল জুম বেশি কাজের। নাইট মোড, AI সিন ডিটেকশন, পোর্ট্রেট মোড, ৪K ভিডিও রেকর্ডিং এগুলো স্ট্যান্ডার্ড হওয়া উচিত। ফ্রন্ট ক্যামেরা কমপক্ষে ১৬MP হলে ভালো সেলফি তোলা যাবে।
৫. ব্যাটারি
মিড রেঞ্জ ফোনে কমপক্ষে ৫০০০mAh ব্যাটারি থাকা উচিত। এটা দিয়ে মোটামুটি এভারেজ ব্যবহারে সারাদিন আরামে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু শুধু ব্যাটারি সাইজ দেখলেই হবে না, ফাস্ট চার্জিং সাপোর্ট অত্যন্ত জরুরি। ৩৩W বা তার বেশি ফাস্ট চার্জিং থাকলে ৩০ মিনিটে ০-৫০% চার্জ হয়ে যাবে। কিছু ফোনে ৬৭W বা এমনকি ১২০W চার্জিং আছে যেটা ১৫-২০ মিনিটে ফুল চার্জ করে ফেলে।
৬. ৫জি সাপোর্ট
বাংলাদেশে ৫জি এখনও সব জায়গায় নেই, কিন্তু দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আপনি যদি ফোনটা দীর্ঘ দিন ব্যবহার করতে চান, তাহলে ৫জি সাপোর্ট অবশ্যই থাকা উচিত। ৫জি মানে শুধু দ্রুত ডাউনলোড স্পিড নয়, কম লেটেন্সি, ভালো নেটওয়ার্ক কভারেজ এবং ভবিষ্যতের অনেক সার্ভিস যুক্ত থাকবে এর মধ্যে। দেখুন ফোনে কয়টা ৫জি ব্যান্ড সাপোর্ট করে। বেশি ব্যান্ড সাপোর্ট মানে বেশি জায়গায় ৫জি পাবেন। ডুয়াল সিম ৫জি থাকলে দুটো সিমেই ৫জি ব্যবহার করতে পারবেন।

Wi-Fi 6 সাপোর্ট থাকলে ঘরের ওয়াইফাইও স্মুথলি চলানো যাবে। Bluetooth 5.2 বা তার উপরে থাকা উচিত ভালো ওয়্যারলেস ডিভাইস কানেক্টিভিটির জন্য।
৭. বিল্ড কোয়ালিটি এবং ডিজাইন
ফোন দেখতে কেমন এবং হাতে কেমন লাগে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক ব্যাক এখনও মিড রেঞ্জে কমন, কিন্তু গ্লাস ব্যাক বা প্রিমিয়াম প্লাস্টিক বা পলিকার্বনেট থাকলে দেখতে অনেক ভালো। ওয়াটার রেজিস্ট্যান্স এখন গুরুত্বপূর্ণ ফিচার হয়ে উঠছে। IP53 বা IP67 রেটিং থাকলে হালকা বৃষ্টি বা পানির ছিটা থেকে ফোনকে নিরাপদ রাখে। IP68 থাকলে পানিতে ডুবে গেলেও সমস্যা নেই।
৮. সফটওয়্যার এবং আপডেট
স্মার্টফোনের অপারেটিং সিস্টেম আপডেট কতদিন পর করা যাবে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। Samsung, Google Pixel মিড রেঞ্জে ৪ বছর পর্যন্ত OS আপডেট দেয়। কমপক্ষে ২ বছরের OS আপডেট এবং ৩-৪ বছরের সিকিউরিটি আপডেট গ্যারান্টি থাকা উচিত। Android এর সর্বশেষ ভার্সন (Android 14 বা তার উপর) থাকলে নতুন ফিচার এবং বেটার সিকিউরিটি পাবেন। কাস্টমাইজেশন অপশন, জেসচার নেভিগেশন, ডার্ক মোড, প্রাইভেসি কন্ট্রোল এর মতো ফিচার দেখতে হবে।

৯. সাউন্ড
যেকোন ফোনের জন্য সাউন্ড কোয়ালিটি ফোনের আকাংক্ষা পূরণ করে কারণ ভিডিও দেখা, মিউজিক শোনা, গেম খেলা সবকিছুতেই ভালো সাউন্ড জরুরি। ডুয়াল স্পিকার থাকলে সাউন্ড ক্লিয়ার, লাউড এবং ব্যালেন্সড হয়।
Dolby Atmos বা Hi-Res Audio সাপোর্ট থাকলে সাউন্ড কোয়ালিটি আরও ভালো হয়। এর পাশাপাশি অডিও কল, ভিডিও কল এবং ভয়েস রেকর্ডিংয়ের জন্য মাইক্রোফোন কোয়ালিটিও গুরুত্বপূর্ণ। নয়েজ ক্যান্সেলেশন থাকলে ভিডিও কলে ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ কম রেকর্ডিং হবে।
১০. এক্সট্রা ফিচার
প্রত্যকে স্মার্টফোনের সাথে কিছু এক্সটা ফিচার আছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, ইন-ডিসপ্লে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর, ফেস আনলক, NFC, IR Blaster, ডুয়াল সিম + মেমোরি কার্ড এবং গেমিং মোড। হয়তো সকল ফোনের মধ্যে এর সবগুলো ফিচার নাও থাকতে পারে তবে থাকলে সেটা ব্যবহারকারীর জন্য বেস্ট হবে।

মন্তুব্য
মিড রেঞ্জ স্মার্টফোন বাংলাদেশের বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি হওয়ায় প্রতিটা ব্র্যান্ড তাদের ফোনে সেরা ফিচারযুক্ত বাজারে নিয়ে আসে। Xiaomi, Realme, Samsung, Oppo, Vivo, OnePlus, Motorola এই সকল ব্র্যান্ডের ভালো মিড রেঞ্জ এর মধ্যে একাধিক স্মার্টফোন বাজারে থাকে। ফোন কেনার আগে নিজের প্রয়োজন বুঝে ক্রয় করা উচিৎ।
ফোনের স্পেসিফিকেশন শীট এর উপরে সবকিছু নির্ভর করে না। এর জন্য রিভিউ পড়ুন, ইউটিউব ভিডিও দেখুন, সম্ভব হলে দোকানে হাতে নিয়ে দেখুন। এর পাশাপাশি উপরের ১০টা ফিচার মাথায় রাখলে আপনি একটা পারফেক্ট মিড রেঞ্জ স্মার্টফোন খুঁজে পাবেন যা দীর্ঘদিন আপনার বিশ্বস্ত সঙ্গী হবে।



