পিরামিড হিসেবে পরিচিত একটি প্রাচীন সমাধি। কয়েক হাজার বছরের নীরবতা। অতঃপর, একদল মানুষ ঢুকে পড়ে সেই ঘুমন্ত রাজত্বে। এরপরই শুরু হয় একে একে মৃত্যু। অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, কিংবা অজানা জ্বরে অকালপ্রয়াণ। এ যেন নিখাদ এক অভিশাপ!
১৯২০-এর দশকে খনন করা হয় মিশরের তরুণ ফারাও তুতাংখামেন-এর সমাধি। প্রত্নতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার ও তার দলের কয়েকজন সদস্য রহস্যজনকভাবে মারা যান এই সমাধি উন্মোচনের পরপরই। তখন থেকেই জন্ম নেয় ‘ফারাওয়ের অভিশাপ’ বা পিরামিডের অভিশাপ নামে বহুল কথিত, পঠিত এবং প্রচারিত কিংবদন্তি। তবে অভিশাপ কি নিছকই অলৌকিক ভয়, না কি এর পেছনে ছিল অদৃশ্য কোনো জীববৈজ্ঞানিক বাস্তবতা?
বিজ্ঞানীরা বলছেন—হ্যাঁ, এবং সেই ‘অভিশাপ’-এর ছায়াতেই লুকিয়ে থাকতে পারে ভবিষ্যতের রক্ত ক্যান্সার নিরাময়ের চাবিকাঠি।
ফারাওয়ের সমাধির অভিশপ্ত অতিথি ছিল ছত্রাক। বিষাক্ত ছত্রাক, অ্যাসপারজিলাস ফ্ল্যাভাসকে দায়ী করা হয় এই মৃত্যুমালার জন্য। এটি একটি হলুদ রঙের বিষাক্ত ছত্রাক। এই ছত্রাক শস্যের উপর জন্মাতে দেখা যায় এবং ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। বিশেষত যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তারাই সহজ শিকার হন এই ছত্রাকের।
১৯৭০-এর দশকে, পোল্যান্ডে ক্যাসিমির চতুর্থ-এর সমাধিতে প্রবেশ করেছিলেন ১২ জন বিজ্ঞানী। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যান তাঁদের ১০ জন। তদন্তে দেখা যায়—সমাধির অভ্যন্তরে ছিল অ্যাসপারজিলাস ফ্ল্যাভাস ছত্রাকের বিস্তার।
কিন্তু এই ‘ফারাওয়ের অভিশাপ’ আজ বিজ্ঞানীদের কাছে হয়ে উঠেছে আশার আলো। ক্যান্সারবিরোধী প্রোটিনের, গুণে অভিশাপ থেকে আশীর্বাদ হয়ে উঠল এই ছত্রাক। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, এই অ্যাসপারজিলাস ফ্ল্যাভাস ছত্রাকে রয়েছে ‘রিপস’ (RiPPs) নামের একটি পেপটাইড শ্রেণির প্রোটিন, যা রক্ত ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া প্রতিরোধে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই রিপস শব্দটি এসেছে “Ribosomally synthesized and Post-translationally modified Peptides”-রাইবোসোম্যালি সিন্থেসাইজড অ্যান্ড পোস্ট-ট্রান্সলেশনালি মডিফাইড পেপটাইডস থেকে। এ ভারী কথাটা সহজভাবে বললে দাঁড়ায়, রিবোজোমে তৈরি এবং পরবর্তীতে রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত পেপটাইড যৌগ।
এই পেপটাইডগুলো জীবদেহে প্রথমে স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়, তারপর বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তাদের গঠন পাল্টে যায়, যার ফলে তারা বিশেষ জৈবিক কাজ করতে সক্ষম হয়—যেমন, ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা। অর্থাৎ, এগুলো এমন প্রোটিন যেগুলি জীবদেহে তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে কার্যকরী গুণ লাভ করে।
গবেষণার সহলেখক ড. কিউয়ুয়ে নিএ বলেন, “এই রাসায়নিক উপাদানগুলো পরিশোধন করা কঠিন, কিন্তু এদের জটিল গঠনই একে বিশেষত্ব দিয়েছে।” যদিও আগে এই ধরনের রিপস সাধারণত ব্যাকটেরিয়াতে পাওয়া যেত, এবার প্রথমবারের মতো ছত্রাকে তা খুঁজে পাওয়া গেল।
চিকিৎসায় সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে এ ছত্রাক। গবেষকরা এই ছত্রাক থেকে অ্যাসপেরিজিমাইসিন (Asperigimycins) নামের একাধিক প্রোটিন বের করেছেন। এগুলো সরাসরি মানব শরীরের ক্যান্সার কোষের উপর প্রয়োগ করে দারুণ ফলাফল পাওয়া গেছে।
চারটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মধ্যে দু’টি প্রোটিন লিউকেমিয়া কোষ ধ্বংসে অতি কার্যকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আরেকটি ধরনে চর্বিজাতীয় এক অণু সংযোজন করা হয়। এরপর এটি হয়ে উঠেছে এমনই শক্তিশালী যে, গত কয়েক দশক ধরে ব্যবহৃত দুটি প্রধান লিউকেমিয়া ওষুধের সমান কার্যক্ষমতা দেখিয়েছে। এই প্রোটিন ক্যান্সার বা কর্কট রোগ নিধনে কীভাবে কাজ করছে, তা একেবারে স্পষ্ট নয়। তবে গবেষকরা ধারণা করছেন, এটি ক্যান্সার কোষের বিভাজন প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। অর্থাৎ ক্যান্সার কোষ আর বাড়তে পারে না।
প্রকৃতির ফার্মেসি এই ছত্রাক হয়ে উঠবে আগামীর চিকিৎসা। এই আশাব্যঞ্জক আবিষ্কানের পরও, মানবদেহে ব্যবহারযোগ্য কোনো ওষুধ তৈরি করতে বহু বছর সময় লাগবে। পরবর্তী ধাপে এই প্রোটিনের প্রাণীদেহে পরীক্ষা চালানো হবে। সফল হলে তবেই শেষ পর্যন্ত মানব দেহে দেয়ার জন্য ক্লিনিকাল ট্রায়াল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছবে।
গবেষক শেরি গাও বলেন, “ছত্রাক আমাদের পেনিসিলিন উপহার দিয়েছিল। প্রকৃতি এখনো অনেক অজানা ওষুধের ভাণ্ডার লুকিয়ে রেখেছে।”
তিনি আরো বলেন, “প্রকৃতি আমাদের সামনে অদ্ভুত এক ওষুধালয় খুলে দিয়েছে। এখন আমাদের দায়িত্ব সেই গোপন সূত্রগুলো উদ্ঘাটন করা।”
অভিশাপের ছায়া থেকে নিরাময়ের আলো হয়ে উঠল এই ছত্রাক। যে ছত্রাক একদিন মৃত্যুর দূত হয়ে হাজির হয়েছিল তুতাংখামেনের অভিশপ্ত সমাধিতে, সেই একই ছত্রাক আজ বিজ্ঞানের আলোয় হয়ে উঠছে সম্ভাব্য জীবনদাতা।
হয়তো ভবিষ্যতের কোনো দিন, সেই বিষাক্ত ছত্রাক থেকেই তৈরি হবে এমন একটি ওষুধ, যা মৃত্যুকে পেছনে ফেলে রক্ত ক্যান্সারের রুগীদের নতুন জীবন দান করবে। তুতাংখামেনের অভিশাপ, হয়তো তখন পরিণত হবে তুতাংখামেনের আশীর্বাদে।