শিরোনাম দেখে চমকে যেতে পারেন। একসময় যিনি কথা বলতে পারতেন না, এখন তিনি গাইছেন গানও! এ যেন বিজ্ঞানের এক বিস্ময়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন এমন এক প্রযুক্তি, যা মাত্র ২৫ মিলিসেকেন্ডে মানুষের মস্তিষ্কের সংকেত পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে কথা তৈরি করতে পারে।
অ্যামিওট্রফিক ল্যাটারাল স্কলেরোসিসে আক্রান্ত এক রোগীর ওপর পরীক্ষামূলকভাবে প্রযুক্তিটি প্রয়োগ করা হয়। তার মস্তিষ্কের ভাষা ও মুখের পেশি নিয়ন্ত্রণকারী অংশে বসানো হয় ২৫৬টি ইলেকট্রোড। স্ক্রিনে দেয়া বাক্য মনে মনে বলার সময় তার মস্তিষ্ক যে সংকেত তৈরি করে, তা এআই প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাষায় রূপ দেয়।
গবেষকরা বলছেন, এটি শুধু শব্দ নয়, বরং মানুষের স্বাভাবিক কথাবার্তার ভঙ্গিমা ও উচ্চারণের ওঠানামাও অনুকরণ করতে পারে। এতে রোগী নিজেই বলছেন, ‘এটা যেন নিজের কণ্ঠেই কথা বলছি।’
আরো চমকপ্রদ বিষয় হলো ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে তার পুরোনো রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফলে যন্ত্রের কণ্ঠ নয়, যেন জীবন্ত একজন মানুষই কথা বলছেন। এ প্রযুক্তি নতুনভাবে কথা বলা অসম্ভব হয়ে পড়া মানুষদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে শুধু চিন্তা দিয়েই কথা বলা, গান গাওয়া কিংবা ফোনে আলাপ-সবই সম্ভব হতে যাচ্ছে।
আর একটি আবিষ্কারের কথা। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (ইউটিএস) বিজ্ঞানীরা এমন একটি এআই মডেল তৈরি করেছেন, যা মস্তিষ্কের তরঙ্গকে শব্দে রূপান্তর করতে পারে। ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রামের (ইইজি) মাধ্যমে মস্তিষ্কের সংকেত নির্দিষ্ট শব্দে রূপান্তর করতে পারে এআই মডেলটি। বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে মস্তিষ্কের তরঙ্গ অনুবাদের সাথে তুলনা করছেন।
এআই মডেলটিকে ইইজি থেকে মস্তিষ্কের সংকেত নির্দিষ্ট শব্দে অনুবাদ করার জন্য প্রশিক্ষিত হয়েছে। পরীক্ষার অংশ হিসেবে বিজ্ঞানী লিওং যখন ১২৮-ইলেকট্রোড ইইজি ক্যাপ পরে বসে ছিলেন, তখন এআই মডেলটি মস্তিষ্কের তরঙ্গ সফলভাবে বিশ্লেষণ করেছে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী লিওং বলেন, মস্তিষ্কের বিভিন্ন উৎস থেকে আসা সংকেত মাথার খুলির উপরিভাগে একত্রে মিলিত হয়। মস্তিষ্কের সংকেত স্পষ্ট করে বোঝার জন্য এআই ব্যবহার করা হচ্ছে।
আরেক বিজ্ঞানী লিন বলেন, এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের তথ্য জানা আক্রমণাত্মক নয়। আসলে মস্তিষ্কের সেই অংশে এটি স্থাপন করতে পারবেন না, যেখান থেকে শব্দ তৈরি হচ্ছে। স্ট্রোক, অটিজমে স্পিচ থেরাপি ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের জন্য যোগাযোগ কৌশল পুনরুদ্ধারের জন্য এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে দারুণভাবে কাজের সুযোগ আছে।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা ইইজি ও এআইকে একত্র করে নানা ধরনের প্রযুক্তি তৈরির কাজ করছেন। গত এপ্রিলে একটি এআই টুল তৈরি করা হয়েছে, যা রোগীদের মস্তিষ্কের দুর্বলতার পূর্বাভাস দিতে সক্ষম। এই এআই টুলটি ঘুমের সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সূক্ষ্ম পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
মানব মস্তিষ্ক আমাদের কল্পনার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হতে পারে- এমনটাই দাবি বিজ্ঞানীদের। এক গবেষণায় গবেষকরা নতুন এক ধরনের ‘সেল মেসেজিং’ শনাক্ত করেছেন, যার খোঁজ এর আগে কখনও পাওয়া যায়নি। এ থেকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে প্রচলিত ধারণার চেয়েও মানব মস্তিষ্ক সম্ভবত বেশি শক্তিশালী।
গবেষণাটি মানব মস্তিষ্কের ‘কর্টিকাল’ কোষের বাইরের অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত, যার ফলাফলে ইঙ্গিত মিলেছে, মানুষের মস্তিষ্কে থাকা নিউরনগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী।
গবেষণায় বিশেষ এক ধরনের ‘ফ্লুরোসেন্ট মাইক্রোস্কোপি’র মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কের কর্টিকাল কোষের বাইরের অংশ বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। এতে দেখা যায়, মস্তিষ্কের একক কোষগুলো ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি সোডিয়াম আয়নের (যা প্রত্যাশিত ছিল) মাধ্যমে ‘সক্রিয়’ হয়ে থাকে।
এ গবেষণার সময় পজিটিভ চার্জযুক্ত আয়নের সমন্বিত অবস্থার সাথে মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষ দিয়ে ভোল্টেজ প্রবাহিত হওয়ার ঘটনা দেখেছেন বিজ্ঞানীরা, যার খোঁজ এর আগে কখনও মেলেনি।
গবেষণায় মস্তিষ্কের ‘ডেনট্রাইট’-এর ওপরও নজর দেয়া হয়েছে, যেগুলো কোষের চারদিকে সৃষ্ট ক্ষুদ্র তন্তুময় শাখাবিশিষ্ট অংশ। মূলত মানুষের মস্তিষ্কে রাসায়নিক বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে নিউরনের একমাত্র চাবিকাঠি হলো ডেনড্রাইট।
‘মস্তিষ্ককে বোঝার ক্ষেত্রে এর কেন্দ্রে থাকা ডেনড্রাইটগুলো সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কারণ প্রতিটি নিউরনের গণনা শক্তি যে নির্ধারণ করে, তার মূল উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে ডেনড্রাইট,’ বলেন এ গবেষণার সহ-লেখক ও ‘হামবোল্ট ইউনিভার্সিটি’র স্নায়ুবিজ্ঞানী ম্যাথিউ লারকাম।
এ গবেষণায় বিশেষ এক ধরনের বৈদ্যুতিক মডেলিং নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন, প্রতিটি নিউরনই গণনামূলক সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবে এর আগের ধারণা ছিল, এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের মধ্যে আরো জটিল নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
মস্তিষ্কের এ অংশটি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আগে যে গবেষণা করেছিলেন তার চেয়ে এ নতুন গবেষণাটি বিজ্ঞানীদেরকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, যেখানে আগের সিংহভাগ গবেষণাই চালানো হয়েছে ইঁদুরের ওপর।
‘‘এটি একটি ‘যুগান্তকারী’ মুহূর্ত ছিল যখন আমরা প্রথমবারের মতো মস্তিষ্কে ডেনড্রাইটিকের কাজ করার সম্ভাবনা দেখেছিলাম।” বলেন লারকাম। “গবেষণার পরীক্ষাগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। তাই এর আগে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি, সে সম্পর্কে জানতে পারার বিষয়টিও খুব ইতিবাচক ছিল।”
জার্মানি ও গ্রিসের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পরিচালিত এ গবেষণাটি ২০২০ সালে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রথমবার প্রকাশ পায়।
এদিকে মানুষের মস্তিষ্কের স্টেম সেল ব্যবহার করে রোবট তৈরি করেছেন একদল চীনা বিজ্ঞানী। কৃত্রিম এ মস্তিষ্ক ব্যবহার করে জটিল সব কাজ করতে পারে রোবটটি।
গবেষকদের মতে, জৈবিক মস্তিষ্কের কিছু বুদ্ধিমত্তা দেখানোর সময় ‘ব্রেইন-অন-চিপ’ রোবটটি মৌলিক কিছু কাজ শিখতে পেরেছিল। উদাহরণ হিসেবে, তার হাত নাড়ানো, বাধা এড়ানো এবং বস্তু আঁকড়ে ধরা।
চীনের তিয়ানজিন ইউনিভার্সিটি ও সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একদল বিজ্ঞানী ল্যাবে তৈরি মস্তিষ্কের সাথে একটি ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেইস জুড়ে দেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে ইন্ডিপেনডেন্ট। এটিই মস্তিষ্কটিকে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের সুযোগ দিচ্ছে।
“চিপের মধ্যে ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেইস এমন এক প্রযুক্তি যা একটি ইন ভিট্রো কালচারড ‘মস্তিষ্ক’ ব্যবহার করে। পাশাপাশি, এতে ইলেক্ট্রোড চিপ রয়েছে যা এনকোডিং-ডিকোডিং ও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।” বলেছেন তিয়ানজিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারঅ্যাকশন অ্যান্ড হিউম্যান-কম্পিউটার ইন্টিগ্রেশন হাইহে ল্যাবরেটরি-এর নির্বাহী পরিচালক মিং ডং।
কাজ করার জন্য মানুষের মস্তিষ্কের মতোই তরল পদার্থ, পুষ্টি, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, এমনকি প্রতিরক্ষামূলক আবরণও দরকার হয় কৃত্রিম এ মস্তিষ্কের।
‘ব্রেইন-অন-চিপ’ প্রযুক্তির উদীয়মান এ খাত হাইব্রিড বুদ্ধিমত্তার বিকাশে সহায়তা করে ‘বিপ্লবী প্রভাব’ ফেলবে বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।
জাপানের বিজ্ঞানীরা একটি রোবটের চেহারা আরো প্রাণবন্ত দেখাতে, মানুষের তরতাজা ত্বক রোবটের মুখে বসিয়েছেন বলে খবর প্রকাশের মাত্র কয়েকদিন পরই নতুন এ সাফল্য এলো বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইন্ডিপেনডেন্ট। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ত্বকের লিগামেন্ট কাঠামোর সাথে বিশেষভাবে ‘ইঞ্জিনিয়ারড’ ত্বকের টিস্যু যোগ করে একটি রোবটকে হাসাতে পেরেছিল।
গবেষকরা বলেছেন, কেবল মানুষের মতো আবেগ প্রকাশের বাইরেও, তরতাজা ত্বক একটি রোবটকে আরো ভালো অনুভব করার ক্ষমতা ও আহত হলে নিজেই নিরাময় করার ক্ষমতা দিতে পারে।