উইকিপিডিয়ায় কওমি শিক্ষার্থীদের পদচারণা কেন জরুরি

উল্লেখযোগ্যভাবে কওমি শিক্ষার্থীরা এর সাথে যুক্ত হলে সামাজিক প্রভাবও পড়বে। তারা নতুন প্রজন্মকে নির্ভুল ও নিরপেক্ষ তথ্য সরবরাহ করবে এবং ধর্মীয় বিষয়গুলোর ভুল ব্যাখ্যার শঙ্কা কমাবে।

কওমি শিক্ষার্থীদের উইকিপিডিয়ায় যুক্ত হওয়া তাদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক
কওমি শিক্ষার্থীদের উইকিপিডিয়ায় যুক্ত হওয়া তাদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক |সংগৃহীত

রায়হান আহমেদ তামীম
বর্তমান যুগে তথ্য ও জ্ঞান সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ। অনলাইনে এই তথ্যভাণ্ডার সরবরাহের ক্ষেত্রে উইকিপিডিয়া এক অনন্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন বিশ্বকোষ হিসেবে এটি প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষকে নির্ভরযোগ্য তথ্য দেয়। ব্যবহারকারীরা শুধু তথ্য পান না; তারা নিজেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এখানে প্রবন্ধ লিখতে, সম্পাদনা করতে এবং নতুন তথ্য সংযুক্ত করতে পারেন। বাংলা উইকিপিডিয়াও এর অংশ। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষার্থী ও তরুণদের প্রচেষ্টায় প্রায় দুই লাখের বেশি প্রবন্ধ—ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজনীতি—ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে।

উইকিপিডিয়া বর্তমানে ৩৪৩টি সক্রিয় ভাষায় বিদ্যমান, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের জন্য তথ্যের একটি উন্মুক্ত ও নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে কাজ করছে। বাংলা উইকিপিডিয়া (bn.wikipedia.org) ২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে এবং বর্তমানে বিশ্বের ৩৪৩টি সক্রিয় ভাষার মধ্যে ৬৩তম অবস্থানে রয়েছে। নিবন্ধের গভীরতা অনুযায়ী এটি ৩১৮টি সক্রিয় উইকিপিডিয়ার মধ্যে ৫ম স্থানে রয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মতোই, কিছু ভাষার উইকিপিডিয়ায় লাখ লাখ প্রবন্ধ আছে, আবার কিছু ভাষায় কেবল কয়েকটি প্রবন্ধই বিদ্যমান। এই পরিসরে বাংলা উইকিপিডিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে, যা বাংলাদেশের তথ্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করছে।

বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণত ছোট প্রবন্ধ ও তথ্য সংশোধনের মাধ্যমে শুরু করে। কলেজ পর্যায়ে সাহিত্য সমালোচনা, সামাজিক গবেষণা ও ইতিহাস সংক্রান্ত লেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—এসব বিষয়ে নিবন্ধ লিখে বা সম্পাদনা করেন। আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও সীমিত পরিসরে যুক্ত হয়েছেন, বিশেষত ইসলামী ইতিহাস ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, ইসলাম সংক্রান্ত নানা প্রবন্ধে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ ওয়ার্কশপ আয়োজন করে নতুন সম্পাদক তৈরি করে। এই শিক্ষার্থীরা তথ্য সংযোজন, ভুল সংশোধন, ব্যাকরণ ও তথ্যসূত্র যাচাই করে বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করছে।

তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, কওমি মাদরাসাপড়ুয়ারা এই তালিকায় প্রায় নেই। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশ হওয়া সত্ত্বেও, উইকিপিডিয়ায় কওমি শিক্ষার্থীদের পদচারণা সীমিত। এটি কেবল বাংলা উইকিপিডিয়াকে সীমিত রাখছে না, দেশ, জাতি ও ইসলামী জ্ঞানচর্চার সম্ভাবনাও কমিয়ে দিচ্ছে।

এর মূল কারণগুলো স্পষ্ট। কওমি মাদরাসার পাঠ্যক্রম মূলত আরবি, উর্দু, ফার্সি ও ইসলামী জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। আধুনিক প্রযুক্তি, বাংলা ও ইংরেজি একাডেমিক লেখার চর্চা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে, তারা অনলাইন জ্ঞানচর্চার সাথে পরিচিতও স্বল্প পরিসরে। এ ছাড়া অনেক কওমি মাদরাসায় ইন্টারনেট ও কম্পিউটার ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফেসবুক বা ইউটিউবের সাথে তারা পরিচিত থাকলেও উইকিপিডিয়ার মতো তথ্যভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে অবদান রাখা তাদের কাছে প্রায় অচেনা। এ ছাড়া বাংলা উইকিপিডিয়ার সহযোগী সংস্থা উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম পরিচালনা করেনি, ফলে কওমিয়ানদের জন্য সুযোগের দ্বার উন্মোচন হয়নি।

এই অনুপস্থিতি শুধু শূন্যস্থান নয়; এটি এক ধরনের পূর্ণভাবে কাজে না লাগানো সুযোগ। কওমি শিক্ষার্থীরা যুক্ত হলে বাংলা উইকিপিডিয়া নতুন মাত্রা পাবে। ইসলামিক জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। হাদীস, ইসলামী আইন ও নিয়ম, তাফসীর, ইসলামী ইতিহাস, উপমহাদেশীয় আলেমদের জীবনী—এসব বিষয়ে প্রবন্ধের সংখ্যা বেড়ে যাবে। আরবি ও উর্দুতে দক্ষ কওমি শিক্ষার্থীরা মূল উৎস থেকে তথ্য এনে প্রবন্ধকে বৈচিত্র্যময় ও প্রমাণভিত্তিক করতে পারবেন।

এ ছাড়া দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ব্যপ্তি আরো সুষম হবে। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা, বিভিন্ন তরিকা, ইসলামী সংগঠন, সামাজিক আন্দোলন—এসব বিষয়ে প্রবন্ধের ঘাটতি আছে। কওমি শিক্ষার্থীরা যুক্ত হলে এই ফাঁক পূর্ণ হবে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঠিক ধারণা সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছাবে।

কওমি শিক্ষার্থীরা বাংলা ছাড়াও আরবি ও ফার্সি এবং উর্দুতে পারদর্শী। ফলে বাংলা উইকিপিডিয়ার পাশাপাশি আরবি ও উর্দু এবং ফার্সিতেও উইকিপিডিয়াতেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। বাংলায় ইসলামী পরিভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে।

উইকিপিডিয়া কেবল প্রবন্ধ লেখার জায়গা নয়; এটি একটি সক্রিয় অনলাইন কমিউনিটি, যেখানে সম্পাদকরা আলোচনা করেন, মতবিনিময় করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সম্পাদকরা সাধারণত সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন। কওমি শিক্ষার্থীরা যুক্ত হলে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দৃঢ়ভাবে উপস্থিত হবে, যা আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মতবিনিময়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে কমিউনিটিকে আরো সমৃদ্ধ করবে।

একইসাথে কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য এ কাজে অংশগ্রহণ অত্যন্ত লাভজনক। এটি তাদের ডিজিটাল দক্ষতা, তথ্য অনুসন্ধান, অনলাইন গবেষণা এবং লেখালেখির সক্ষমতা উন্নত করবে। প্রবন্ধ লেখা, তথ্য যাচাই এবং সম্পাদনার মাধ্যমে তারা একাডেমিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে।

উল্লেখযোগ্যভাবে কওমি শিক্ষার্থীরা এর সাথে যুক্ত হলে সামাজিক প্রভাবও পড়বে। তারা নতুন প্রজন্মকে নির্ভুল ও নিরপেক্ষ তথ্য সরবরাহ করবে এবং ধর্মীয় বিষয়গুলোর ভুল ব্যাখ্যার শঙ্কা কমাবে।

সর্বোপরি, উইকিপিডিয়ায় কওমি শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি জরুরি—যাতে দেশ, জাতি এবং ইসলামের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। পাশাপাশি, তারা নিজেরাও এই প্রক্রিয়ায় উপকৃত হবে। বাংলা উইকিপিডিয়া আরো বহুমাত্রিক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হিসেবে গড়ে উঠবে। আধুনিক ও ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার এই সমন্বয় বাংলাদেশের মুক্ত জ্ঞানচর্চার প্রতীক হিসেবে এটিকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

লেখক : কবি ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

[email protected]