বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ বাণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। বর্তমানে এই সমুদ্রপথ সাইবার আক্রমণকারীদের কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বিগত চার বছরে আক্রমণ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। আক্রমণ সামাল দেয়ার গড় খরচ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলার বা প্রায় চার লাখ পাউন্ডে।
লন্ডন-ভিত্তিক বাণিজ্যিক আইন সংস্থা এইচএফডব্লিউ (HFW)-এর আইনজীবী হেনরি ক্ল্যাক বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে বেশি মামলায় মুখোমুখি হয়েছি নাইজেরীয় সংগঠিত অপরাধী দলগুলোর বিপক্ষে। তারা গত কয়েক বছরে একাধিক উচ্চমূল্যের ‘ম্যান-ইন-দ্য-মিডল’ (সাইবার আক্রমণ) জালিয়াতির জন্য দায়ী।’
এই ধরনের জালিয়াতিতে হ্যাকার দুই পক্ষের মধ্যকার যোগাযোগে গোপনে অনুপ্রবেশ করে। এরপর সংবেদনশীল তথ্য যেমন-লগইন ডিটেইলস, আর্থিক তথ্য এবং কম্পিউটার সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। এরপর সাইবার অপরাধীরা চুরি করা তথ্য ফেরত দিতে, নয়তো কোম্পানির কম্পিউটার সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে টাকা দাবি করে।
এইচএফডব্লিউ-এর তথ্য বলছে, এধরনের হ্যাকিং জাহাজ শিল্প খাতে ক্রমশ বাড়ছে। ২০২২-২০২৩ সালে এ ধরনের আক্রমণ সামাল দেয়ার গড় খরচ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলার বা চার দশমিক এক লাখ পাউন্ডে।
আবার যেসব ক্ষেত্রে সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞরা হ্যাকারদের সহজে সিস্টেম থেকে সরাতে পারেন না, সেসব ক্ষেত্রে গড় মুক্তিপণ দাঁড়াচ্ছে তিন দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক চেম্বার অব শিপিং (ICS)-এর মেরিন ডিপার্টমেন্টের পরিবেশ ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপক জন স্ট্যাপার্ট বলেন, ‘বিশ্ব আজ এতটাই আন্তঃসংযুক্ত যে সাইবার নিরাপত্তা জাহাজ শিল্পের জন্য বড় উদ্বেগ। জাহাজ শিল্প বিশ্বব্যাপী সাইবার অপরাধীদের শীর্ষ ১০ লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে।’
নেদারল্যান্ডসের এনএইচএল স্টেন্ডেন ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস-এর গবেষকরা সাম্প্রতিক বছরগুলোর সাইবার হামলার ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। ২০২১ সালে যেখানে এমন হামলা ছিল মাত্র ১০টি, ২০২৩ সালে তা বেড়ে অন্তত ৬৪-এ পৌঁছেছে। আগের তুলনায় যা প্রায় সাত গুণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিটাইম আইটি সিকিউরিটি গবেষণা দলের জেরুন পাইপকার বলেন, ‘আমরা দেখেছি অনেক ঘটনার সাথে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরান এই চারটি দেশের সরকার জড়িত।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে কিছু সরঞ্জাম পাঠানো হচ্ছিল। একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে আমরা দেখতে পেলাম কিছু লোক সেই চালানের তথ্য শেয়ার করছে এবং বলছে কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানলে লজিস্টিক চেইনে বিঘ্ন ঘটানো যাবে।’
জাহাজ শিল্প এখন অনেক বেশি আধুনিক হয়ে গেছে। নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তি, যেমন- ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট সার্ভিস জাহাজগুলোকে বাইরের জগতের সাথে বেশি সংযুক্ত করেছে। তাই এগুলো হ্যাক হওয়ার ঝুঁকিও বেড়েছে।
ডিজিটালাইজেশন আরও নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে যেমন জিপিএস জ্যামিং এবং স্পুফিং। সাইবার সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান ক্ল্যারটির আর্ক ডায়ামান্ট বলেন, ‘জিপিএস স্পুফিং মানে হলো ন্যাভিগেশন সিস্টেমকে ভুয়া অবস্থান দেখানো। এতে জাহাজ সম্পূর্ণ অন্য পথে চলে যায়। কখনো কখনো অগভীর পানিতে ঢুকে জাহাজের শারীরিক ক্ষতিও হতে পারে।’
২০২৩ সালের মে মাসে এমএসসি এন্টোনিয়া (MSC Antonia) নামে একটি কনটেইনার জাহাজ লোহিত সাগরে আটকে যায়। সন্দেহ করা হয় এটি জিপিএস স্পুফিং আক্রমণের শিকার হয়েছে।
জিপিএস জ্যামিং ও স্পুফিং ঠেকানো কঠিন এবং ব্যয়বহুল। তবে বর্তমানে ‘অ্যান্টি-জ্যাম’ প্রযুক্তি বাজারে আছে।
কার্গো জাহাজের আরেকটি দুর্বলতা হলো, সেন্সর এর ব্যবহার। এই সেন্সরগুলো ডেটা প্রেরণ করে যা হ্যাকারদের আরেকটি প্রবেশ পথ তৈরি করে।
সুখবর হলো শিল্প এখন নিরাপত্তা বাড়াতে কাজ করছে। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (IMO) তার বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা কোডে নতুন সাইবার নিরাপত্তা বিধান যুক্ত করেছে।
জন স্ট্যাপার্ট বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় শিল্প এখন হুমকি মোকাবিলায় বিগত ছয়-সাত বছর আগের তুলনায় ভালো অবস্থানে। শিল্পজুড়ে সাইবার হামলা ও সাইবার অপরাধ নিয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে এবং আগামী বছরগুলোতে তা আরও বাড়বে।’
বিবিসি নিউজ থেকে অনুবাদ করেছেন মিজানুর রহমান