দিন দিন বাড়ছে এমন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার কমিয়ে আনছেন। কারণ তারা মনে করছেন, এআই তাদের অলস করছে, মৌলিক চিন্তাশক্তি নষ্ট করছে, সৃজনশীলতাকে গ্রাস করছে।
বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারদিকে
আমি যাই তার দিনপঞ্জিকা লিখে- সুকান্তের কবিতায় যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলত, তার স্ফুলিঙ্গ আজ ছড়িয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল জগতেও। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাজত্বে। যে বিদ্রোহ একদিন ছিল শোষণের বিরুদ্ধে, আজ তা দাঁড়িয়েছে কিবোর্ডের বর্ণমালার সামনে। যারা আজ বিদ্রোহ করছে, তারা কলমের পাশে দাঁড়ানো এক ঝাঁক ছাত্র, যারা ঘোষণা করছে, ‘এই লেখা আমার নিজের হতে হবে। আমি নিজে লিখব।’
চ্যাটজিপিটির বিরুদ্ধে ছাত্রদের এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ
আল পাইস-এর সাংবাদিক সুসানা পেরেজ সোলোর লিখেছেন, বস্টনের এমারসন কলেজের রাজনীতি ও যোগাযোগ বিভাগের ২০ বছরের ছাত্রী মোনিকা দে লস অ্যাঞ্জেলেস রিভেরা সোসা জানালেন, ‘কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে ইন্টার্নশিপ, এসাইনমেন্ট, পড়াশোনা আর অন্যান্য কাজের চাপে আমি চ্যাটজিপিটি ব্যবহার শুরু করি। প্রথমে ছোটখাটো কাজে ওকে ডাকতাম। ধীরে ধীরে দেখি ও আমার লেখার ধরন, আগের লেখাগুলোর ভাব বুঝে যাচ্ছে। শেষমেশ পুরো লেখালিখির কাজটাই ওর হাতে তুলে দেই।’ কিন্তু পরে হঠাৎই থমকে দাঁড়াতে হয় তাকে। ‘আমি বুঝতেই পারছিলাম না, শেষ কবে নিজে একটা প্রবন্ধ লিখেছি। অথচ, লেখা ছিল আমার প্রিয় অভ্যাস। এটাই আমাকে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার বন্ধ করতে বাধ্য করে।’
এই ভাবনা যদিও সব শিক্ষার্থীদের নয়, কিন্তু এটি এখন আর একক অভিজ্ঞতা নয়। দিন দিন বাড়ছে এমন ছাত্রদের সংখ্যা যারা এআই-এর ব্যবহার কমিয়ে আনছেন। কারণ তারা মনে করছেন, এআই তাদের অলস করছে, মৌলিক চিন্তাশক্তি নষ্ট করছে, সৃজনশীলতাকে গ্রাস করছে।
‘আমি অলস হয়ে যাচ্ছি’- এক ছাত্রীর স্বীকারোক্তি
বার্সেলোনার র্যামন লুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মাকারেনা পাজ গুয়েররো বলেন, ‘আমি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করি না। এতে আমার কোনো উপকার হয় না। গত বছর আমি নিজেকে কম সৃষ্টিশীল মনে করেছি। এবার সেটা ঠেকাতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো এক্সপেরিমেন্ট, শেখা, আর বিশ্লেষণী মন গড়ে তোলা। প্রশ্ন কপি করে একটা যন্ত্রে ঢুকিয়ে দিলাম, পড়লামও না- এটা কি কোনো শিক্ষা হলো?’
‘যন্ত্র আমাদের জায়গায় চিন্তা করছে’- মাইক্রোসফটের গবেষণা
মাইক্রোসফট ৩১৯ জন কর্মীর ওপর গবেষণা চালিয়ে জানিয়েছে, যারা নিয়মিত এআই ব্যবহার করেন, তারা একই কাজের জন্য কম বৈচিত্র্যময় ফলাফল তৈরি করেন। মানে, যন্ত্রে ভরসা করলে নিজের ভাবনা কমে যায়। যারা নিজেদের কাজে আত্মবিশ্বাসী, তারা এআই-এর ওপর নির্ভর করেন কম।
স্পেনের ইউনিভার্সিটি অফ ভিগোর অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো হাভিয়ের গনজালেস কাস্তানো, যিনি নিজেও চ্যাটবট উন্নয়নে যুক্ত। তিনি বলছেন, ‘যারা নিজেদের ওপর খুঁতখুঁতে, তারা এআই-এর ওপর কম নির্ভর করেন। তারা জানেন, তাদের কাজের মান এআই দিয়ে পাওয়া যাবে না।
‘সমস্যা ছাত্রদের নয়, সমস্যাটা শিক্ষা ব্যবস্থার’
ব্রাসেলসের রয়্যাল কনজারভেটরির ২৫ বছরের পিয়ানোবাদক ও পেডাগজির ছাত্রী ভায়োলেটা গনজালেস বললেন, ‘যদি কোনো অ্যাসাইনমেন্ট এমন হয় যা যন্ত্র অনায়াসে করতে পারে, তাহলে ছাত্রদের নয়, বরং সেটার দায় শিক্ষা ব্যবস্থার। তবে বিশ্লেষণ দরকার এমন অ্যাসাইনমেন্টে এআই এখনো মানুষের জায়গা নিতে পারেনি।’
তার মতে, ‘চ্যাটজিপিটির উত্তর তো ক্যানভাস মাত্র, তথ্য জোগাড় করে দেয়। ওর নিজস্ব কিছু নেই।’
গুগল বনাম জেনারেটিভ এআই, পার্থক্য কোথায়?
মাকারেনা বলেন, ‘গুগলে আমরা প্রশ্ন দিয়ে বিভিন্ন উৎস ঘেঁটে উত্তর গড়ি। গুগল শেখায় তথ্য বিচার করতে, এআইতে সেটা হারিয়ে যায়।’
এখন তিনি গুগলের পরিবর্তে ব্যবহার করছেন ইকোসিয়া, যা একটি পরিবেশবান্ধব সার্চ ইঞ্জিন। সার্চ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বন তৈরি করে।
শিক্ষার্থীরা বলছে, এআই-এর ব্যবহারে বিশাল পরিমাণ পানি ব্যবহার হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
‘না জানলেও বানিয়ে বলে’- চ্যাটজিপিটির আরেক দোষ
ভায়োলেটা গনজালেস বলেন, ‘চ্যাটজিপিটি না বলতে পারে না। যা জানে না, তা বানিয়ে দেয়। এটাই সবচেয়ে ভয়ানক। আমি যখন এটা বুঝি, তখন থেকেই ওর দেয়া তথ্য যাচাই করে নিচ্ছি। আর যাচাই না করলে, আপনার কাজ সীমিত হয়ে পড়ে।’
তার বক্তব্যে মোনিকা সোসা যোগ করলেন, ‘সমালোচনামূলক চিন্তা না করলে চ্যাটজিপিটির ওপর নির্ভর করলেই হবে না। তা না হলে আমাদের নিজের বিচারবোধটাই হারিয়ে যাবে।’
‘চিন্তা এক ধরনের শরীরচর্চা’- মস্তিষ্ক ভুলে যেতে পারে!
মোনিকা বলেন, ‘সমালোচনামূলক চিন্তা হলো এক ধরনের শরীরচর্চা। আপনি যদি সেটা না করেন, তবে শরীর যেমন ভুলে যায়, মস্তিষ্কও তাই ভুলে যাবে।’
প্রোগ্রামিং হোক বা সাহিত্য, এআই এখনো সীমিত
প্রফেসর টনি লোজানো বলছেন, ‘প্রোগ্রামিং আর কোডিং এক নয়। চ্যাটজিপিটি যেমন এক লাইন কোডে হাজারো কাজ করতে পারে, কিন্তু নতুন সমস্যা সমাধানে ওর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’
‘চ্যাটজিপিটির নিজস্ব ভাষার ধাঁচ তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, সব লেখার ধরন একরকম হয়ে যাচ্ছে। বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে।’
‘সবাইকে হাই-এডুকেটেড হতে হবে না’- চিন্তাজগতের সংকোচন?
অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো গনজালেস বলেন, ‘সবাইকে কি উচ্চশিক্ষিত হতে হবে? এমন নয়। হয়তো কিছু দক্ষতা সময়ের সাথে হারিয়ে যাবে। এক সময় শুধু মঠে কিছু সন্ন্যাসী থাকতেন, যারা গভীরভাবে চিন্তা করতেন। পাঁচ বছর পরে হয়তো ভাষা শেখার দরকারও পড়বে না।’
‘চিন্তার স্রোত এখন মাত্রায় হারাচ্ছে’- নিকলাস কারের হুঁশিয়ারি
জেনারেটিভ এআই আসার আগে ২০১১ সালে নিকলাস কার লিখেছিলেন, ‘একসময় আমি শব্দের সমুদ্রে ডুব দিতাম। এখন আমি কেবল স্কুটার চালিয়ে উপরের জলছাপটুকু স্পর্শ করছি।’
তার বই ‘দ্য শ্যালোজ: হোয়াট দ্য ইন্টারনেট ইজ ডুইং টু আওয়ার ব্রেইনস’-এ তিনি বলেছিলেন, ‘প্রযুক্তি আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়, আর সে দৃষ্টিভঙ্গিই একসময় বদলে দেয় আমাদের পরিচয়।’
চ্যাটজিপিটিই বলছে, ‘জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই উত্থান এক অদ্ভুত প্যারাডক্স তৈরি করেছে- যত বেশি এটি আমাদের হয়ে চিন্তা করে, তত কম আমরা নিজেরা চিন্তা করি।’
শেষ কথা
বিদ্রোহ শুধু রাজপথে হয় না, মনের ভেতরেও হয়। এই ছাত্রছাত্রীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, হাতের মুঠোয় থাকা প্রযুক্তি সবসময় আশীর্বাদ নয়। যন্ত্র যদি আমাদের হয়ে চিন্তা করে, আমরা ভাবি কবে? প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতের ছাত্র কি তার নিজের জবানিতে বলবে, ‘এই লেখাটা আমার?’ নাকি সব লেখা এক ছাঁচে ঢালা হবে?
কাগজ-কলমে ফেরার ডাক যেন শোনা যাচ্ছে আবার। যারা এখনো হাতের লেখায় নিজেকে খুঁজে পায়, তারা হয়তো সুকান্তের সেই কবিতার বিদ্রোহী উত্তরসুরীই, যারা আজও নিজের দিনপঞ্জিকা নিজের হাতে লিখেন।