আদর্শ ওয়াজ মাহফিলের বৈশিষ্ট্য

‘মাহফিল-পরবর্তী শ্রোতার মধ্যে আমলি পরিবর্তন আসতে হবে, আচরণে ইসলামী আদর্শের প্রতিফলন ঘটতে হবে। সত্যবাদিতা, আমানতদারি, পরোপকার, নামাজ, রোজা ও সমাজকল্যাণের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালনের অঙ্গীকার নবায়ন করতে হবে। প্রকৃত মাহফিলের প্রভাব তখনই সার্থক হবে, যখন জীবনাদর্শ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে গড়ে উঠবে।’

বেলায়েত হুসাইন
ড. এবিএম হিজবুল্লাহ, মুফতি আব্দুল বাতেন কাসেমী, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ও মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরি
ড. এবিএম হিজবুল্লাহ, মুফতি আব্দুল বাতেন কাসেমী, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ও মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরি |ডিজাইন : নয়া দিগন্ত

আগে মানুষ খুব অল্প পরিমাণে ওয়াজ শুনত এবং তাদের মধ্যে সেই অনুযায়ী আমলের একটা প্রচেষ্টাও দেখা যেত। বিপরীতে ডিজিটাল দুনিয়ায় ওয়াজ সহজলভ্য হওয়ায় মানুষের মধ্যে তা শোনার প্রবণতাও বেড়েছে। তবে, তাদের জীবনে ওয়াজের আশানুরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু কেন এই অবনতি, এর নানা কারণ রয়েছে। এককথায় বলা যায়- আদর্শ মাহফিলের সঙ্কটই আমলের এই অবনতি। তাহলে আদর্শ মাহফিলের বৈশিষ্ট্য কী- সেই উত্তরই দিয়েছেন দেশের শীর্ষ পাঁচজন আলেম। তাদের মন্তব্যে উঠে এসেছে- মাহফিল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য থেকে শুরু করে, বক্তাদের লক্ষ্য, মাহফিলের সময় নির্ধারণ, শ্রোতাদের নিয়ত কেমন হবে ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিষয়। সেগুলো তুলে ধরা হলো-

আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে মাহফিল আয়োজন
খন্দকার মনসুর আহমদ
নায়েবে মুহতামিম, জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম

একান্তভাবে মানুষের ধর্মীয় উপকার সাধন ও সমাজশুদ্ধির উদ্দেশ্যেই ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা। তাহলে এর ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী ও হৃদয়স্পর্শী। পক্ষান্তরে ওয়াজকে উপলক্ষ বানিয়ে জনগণের কাছ থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বৈষয়িক উন্নতির উপায় সন্ধান করলে তা শ্রোতাদের হৃদয়ে ততখানি প্রভাবসঞ্চার করবে বলে মনে হয় না। তাই এ লক্ষ্যে দীনি ওয়াজ-মাহফিল আয়োজনের বিষয়টি আমার কাছে তেমন যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। হাদীসের বক্তব্য হলো- ‘কর্মের প্রতিদান নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ তাই ওয়াজ মাহফিল একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে তাকওয়ার পরিবেশে সমাজ সংশোধন ও জনগণের ধর্মীয় কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যেই হওয়া উচিৎ। (অবশ্য ধর্মীয় স্থাপনা ও দীনি প্রতিষ্ঠানের বৈষয়িক উন্নতির জন্য পৃথকভাবে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে অনুষ্ঠান হতে পারে। পাশাপাশি ধর্মীয় স্থাপনা ও দীনি প্রতিষ্ঠানের বৈষয়িক প্রয়োজন ও উন্নতির প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং সাধ্যমতো সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই জনগণের অপরিহার্য কর্তব্য।

মুখলিস, আমলদার বক্তা নির্বাচন
ড. এবিএম হিজবুল্লাহ
সাবেক প্রফেসর, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

আয়োজকদের খেয়াল রাখতে হবে- বক্তা যেন মুখলিস, আমলদার, দীনদার, পরহেজগার হন। যাদের আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন। দীনের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে তারা সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। লৌকিকতা পরিহার করে দরদ নিয়ে কথা বলবেন। বক্তাগণ ইখলাসের সাথে কোরআন-হাদীস ও দ্বীনের আলোকে বয়ান করবেন। নিজের মনগড়া কোনো কথা সংযোজন করবেন না। তাদের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শ্রোতাদের জন্য বেশি ফলপ্রসু হবে। কোনো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাহফিলকে ব্যবহার করা যাবে না। বক্তাগণকে সমাজের নেতৃত্ব দিতে হবে। তারা মানুষকে ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। মানুষকে আমলের প্রতি আগ্রহী করবেন। আকিদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সঠিক বক্তব্যের আলোকে প্রচলিত কুসংস্কার খণ্ডন করবেন। ওয়াজ মাহফিল যেন নিছক কৌতুক ও গল্পের সার্কাসে পরিণত না হয়। বিষয় বহির্ভূত অনর্থক কথা বলে সময় নষ্ট না করা যাবে না।

সঠিক সময় ও সহনীয় সাউন্ড নির্ধারণ
মুফতি আব্দুল বাতেন কাসেমী
মুহতামিম ও খতিব, জামিয়া আরাবিয়া মোহাম্মাদিয়া মসজিদ-মাদ্রাসা কমপ্লেক্স

মাহফিল হলো নাসিহা বা উপদেশের জন্য। আদ-দীনু আন নাসিহা। দীন তথা ধর্ম হলো- মানুষের কল্যাণকামিতা বা মঙ্গল কামনা করা। কোরআনে কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘হে নবী, আপনি মানুষকে উপদেশ দিন।’ আর উপদেশ মানুষের জন্য, বিশেষ করে ঈমানদারদের জন্য অনেক উপকারী। তবে, সবকিছুরই উপযুক্ত সময় আছে। ভালো জিনিস ভালো সময়ে বলতে হয়। সুতরাং ওয়াজ মাহফিলও এমন সময় আয়োজন করা উচিৎ যখন মানুষের মস্তিষ্ক খালি থাকে এবং কথাটা তারা আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে পারে। সেই হিসাবে আমার কাছে মনে হয়- মাহফিল খুব গভীর রাত পর্যন্ত না হওয়া। ইশার নামাজের পর সর্বোচ্চ ১০-১১টা পর্যন্ত হতে পারে। যেহেতু ফজর আছে এবং পরদিন কর্মস্থলেও যেতে হয়। এজন্য দীর্ঘ রাত করা উচিৎ নয়। রাত দীর্ঘ হলে মানুষের মধ্যে বিরক্তিভাব চলে আসে। আর মাইকের ব্যবহার এমনভাবে হওয়া উচিৎ যেন কারো কোনো কষ্ট না হয়। অনেক রোগী আছেন বা অনেকে অনেক কষ্টের মধ্যে থাকেন। এসবকিছু বিবেচনা করেই মাইকের ব্যবহারটা হওয়া উচিৎ বলে মনে করি।

মাহফিলকে নেতা ও বিত্তশালীদের প্রভাবমুক্ত করণ
মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী
বরেণ্য আলেম, বক্তা ও রাজনীতিবিদ

ইদানিং আমাদের মাহফিলগুলোতে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা কিংবা বিশেষ কোনো ব্যবসায়ীকে অতিথি করার একটা সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মাহফিলের ব্যয়ভার বহন করার ক্ষেত্রে কারো অনুদান পাওয়া অথবা কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে অতিথি করে সম্মানিত করা যেতে পারে। এই দিক থেকে এটি দোষের কোনো বিষয় নয়। তবে, মাহফিলে তাদের কোনো প্রকার অন্যায় হস্তক্ষেপ, অসদাচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য যে কোনো আয়োজনের ভাবগাম্ভীর্যকে সন্দেহাতীতভাবে বিনষ্ট করে। পক্ষান্তরে ঐতিহ্যমণ্ডিত এ মাহফিলগুলোতে কখনো এমন অতিথি আগমন করেন, যিনি পুরো সময়টা গভীর মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শোনেন- নিঃসন্দেহে এটা প্রশংসনীয় এবং মাহফিল শুধু সাধারণ মানুষের জন্যই নয়, তাদের জন্যও। মাহফিলে ওয়াজ শুনে যদি কোনো অতিথির হৃদয় পরিবর্তন হয়, সেটাও বিরাট সাফল্য।

মাহফিলে হেদায়েত ও আত্মশুদ্ধি অর্জন
মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরি
মুহাদ্দিস, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী

মাহফিল কেবল সাময়িক উপভোগ ও অনুপ্রেরণার জন্য নয়; বরং এটি জীবনের দিকনির্দেশনা প্রদানকারী এক আলোকবর্তিকা। মাহফিলে শ্রোতাদের উচিত হেদায়েতের নিয়তে বয়ান শোনা—আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন ও আত্মশুদ্ধির অভিপ্রায়ে। মনোযোগ ও শ্রদ্ধার সাথে আলেমদের নসিহত গ্রহণ করলে, তবেই জ্ঞানের আলো হৃদয়ে প্রবেশ করে এবং তা আমলে রূপ নেয়। মাহফিল-পরবর্তী শ্রোতার মধ্যে আমলি পরিবর্তন আসতে হবে, আচরণে ইসলামী আদর্শের প্রতিফলন ঘটতে হবে। সত্যবাদিতা, আমানতদারি, পরোপকার, নামাজ, রোজা ও সমাজকল্যাণের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালনের অঙ্গীকার নবায়ন করতে হবে। প্রকৃত মাহফিলের প্রভাব তখনই সার্থক হবে, যখন জীবনাদর্শ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে গড়ে উঠবে।

লেখকের ইমেইল: [email protected]