মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে বিশেষত, নির্মাণশৈলীতে নিজেদের আভিজাত্য ও উন্নত রুচির পরিচয় দিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে বর্তমান আধুনিককালের মুসলমানদের চেয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের রুচি ও উন্নত সৃষ্টিশীলতা ছিল আরো বহুগুণে এগিয়ে। যার প্রমাণ মেলে প্রাচীন যামানার মসজিদ-মাদরাসার আকর্ষণীয় স্থাপত্যশৈলী দেখে। এমনই চোখধাঁধানো একটি স্থাপনা পুরান ঢাকার তারা মসজিদ। তারায় তারায় খচিত হওয়ার জন্য মসজিদটিকে এই নাম দেয়া হয়েছে।
আরমানিটোলার আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটিকে কেউ কেউ মির্জা গোলাম পীরের মসজিদ বা সিতারা মসজিদ নামেও ডাকেন। ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে ঢাকার মহল্লা আলে আবু সায়্যিদে (পরে এলাকাটির নাম হয় আরমানিটোলা) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। তিনিই নির্মাণ করেন তারা মসজিদ। গোলাম পীর ছিলেন ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সায়্যিদের নাতি।

নির্মাণের পর শুরুতে এটি মির্জা সাহেবের মসজিদ নামে পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। তার সময় মসজিদে তিনটি গম্বুজ ছিল। এর দৈর্ঘ্য ছিল ৩৩ ফুট (১০ দশমিক ০৬ মিটার) ও প্রস্থ ১২ ফুট (৪ দশমিক ০৪ মিটার)। এরপর ১৯২৬ সালে তারা মসজিদ সংস্কারের উদ্যোগ নেন ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান ব্যাপারী। সেই সময় তিনি মোজাইক ব্যবহার করেন এবং এর কারুকাজে ব্যবহৃত হয় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ। সংস্কারের সময় মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়।
এভাবে কেটে যায় ছয় দশকেরও বেশি সময়। তারপর ১৯৮৭ সালে আবার সংস্কারের মাধ্যমে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ পায় তারা মসজিদ। পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটি গম্বুজ ও তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। ফলে মসজিদের দৈর্ঘ্য হয় ৭০ ফুট (২১ দশমিক ৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭ দশমিক ৯৮ মিটার)। বতর্মানেও এই আকৃতিতে আছে।
মসজিদটির মাটি ছুঁয়ে থাকা দেয়াল ও মেঝে থেকে শুরু করে ছাদের ওপরের গম্বুজের চূড়ার শীর্ষ পর্যন্ত অনিন্দ্যসুন্দর নকশায় আবৃত্ত। দুর্লভ প্রাচীন টাইলস, রংবেরঙের কাচের টুকরা, চিনামাটির ফলকসহ হরেক রকমের উপকরণ দিয়ে সুনিপুণভাবে মসজিদটির ভেতর–বাইরের সর্বাঙ্গ অলংকৃত করে তোলা হয়েছে। নকশা করা এই পদ্ধতির নাম ‘চিনি টিকরি’। বিশেষ করে ভেতরে বাতি জ্বালালে দেয়ালে রঙিন কাচের টুকরা কেটে বসানো চিনি টিকরির নকশা এমন বর্ণিল হয়ে ওঠে যে প্রথম দর্শনে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

১৯৮৭ সালে সংস্কারের পর থেকে তারা মসজিদটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। আর ব্যবস্থাপনার ভার দেয়া হয়েছে ওয়াক্ফ প্রশাসনের কাছে। এখানে একটি হেফজখানা ও মক্তব এবং লিল্লাহ বোর্ডিং রয়েছে। সরকারি অনুদান ও এলাকাবাসীর দানে এগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
তারা মসজিদের ভেতরে চারটি ও বারান্দায় তিনটি কাতার রয়েছে। এতে প্রায় একসাথে ২৮৫ জন মুসল্লি জামাতে নামাজ পড়তে পারেন। দ্বিতীয়বার সংস্কারের সময় পুরোনো বারান্দার সামনেও অনেকটা জায়গা মার্বেল পাথরের ফলক পেতে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বর্তমানে ঐতিহাসিক এই মসজিদটির ইমামের দায়িত্বে আছেন মাওলানা শফিকুল ইসলাম। নয়া দিগন্তকে তিনি জানান, ২০১৯ সাল থেকে তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন। আর মুয়াজ্জিন হিসেবে আছেন মাওলানা তোফাজ্জাল হোসেন। তিনি জানান, ‘এখানে মুসল্লিরা তো দৈনন্দিন পাচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে আসেনই, পাশাপাশি প্রতিদিন অসংখ্য দেশী-বিদেশী পর্যটক, রাষ্ট্রদূত, গণ্যমান্য অতিথিরাও ঢাকার প্রাচীন এই মসজিদ দেখতে আসেন দর্শনীয় স্থান হিসেবে।’ শত শত বছরের প্রাচীন এই মসজিদটির মনকাড়া স্থাপত্যসৌকর্য ও আধ্যাত্মিক আকর্ষণই মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে আসে।