সীমান্ত কেবল কোনো কাঁটাতারের বেড়া নয়- এটি প্রতিবেশী দেশের প্রতি আস্থা, মানবিকতা ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রতীক। সম্প্রতি ভারতের ‘পুশইন’ নীতির জেরে এই আস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। যাচাই-বাছাই, আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবাসন চুক্তি বা আন্তর্জাতিক প্রোটোকল ছাড়া মানুষকে জোর করে ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে- যা কেবল অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার নয়; এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বিডি নিউজ২৪।
‘পুশইন’ বলতে বোঝানো হয়- পরিচয়পত্র বা আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া এক দেশের সীমান্তরক্ষীদের অপর দেশে মানুষ ঠেলে পাঠানো। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে, এমন ঘটনা কম নয়। সূত্রের তথ্য ও মানবাধিকার রিপোর্টগুলো বলছে, অনেকে এদের মধ্যে অনেকেই প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় নাগরিক-নিরাপত্তা বা ভাষা-ধর্মভিত্তিক সন্দেহের কারণে জবরদস্তি করে সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। আবার কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও অনানুষ্ঠানিকভাবে ফেরত দেয়া হয়েছে; এমন ব্যবহার আন্তর্জাতিক অধিকার ও প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে কূটনৈতিক দূরত্ব বৃদ্ধিপ্রবণ হয়েছে এবং সীমান্তনীতিতে কড়া কণ্ঠস্বর উঠে এসেছে। স্থানীয় রাজনীতির চাপ, নির্বাচনী বক্তৃতা ও নিরাপত্তা বয়ান এসব মিলিয়ে ‘পুশইন’ নীতিকে কখনো জনআবেগ ও কখনো নিরাপত্তা হুমকির আড়ালে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা দেখা গেছে। কোপেনহেগেন স্কুলের সিকিউরিটাইজেশন তত্ত্ব অনুযায়ী, অভিবাসনকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ হিসেবে আকার দিলে নিয়মের বাইরে কঠোর পদক্ষেপের পথ খুলে যায়- এটাই এখানে লক্ষণীয়।
মানবিক বিবেচনায় এ নীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে সাধারণ মানুষকে বয়স্ক, অসুস্থ, নারী ও শিশুসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীকে। বহু ঘটনার বিবরণ মানবাধিকার লঙ্ঘন, আটক ও জবরদস্তি, জব্দকৃত পরিচয়পত্র ও জোরপূর্বক-দেশত্যাগের কথা প্রকাশ করেছে। অদ্ভুদ কথা কয়েকটি ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তিরা বৈধ আধার বা ভোটার পরিচয়পত্র দেখালেও ‘ভেরিফিকেশন প্রয়োজন’ বলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়নি; পরবর্তীতে দেখা গেছে, তারা বাংলাদেশে পৌঁছে গেছেন। এমন পরিস্থিতি কেবল ব্যক্তিগত দুর্ভোগই নয়; এটি রাষ্ট্রীয় সর্বস্বত্ত্বার পরীক্ষা।
আইনি ও কূটনৈতিক স্তরে সমস্যা স্পষ্ট। ভারতের পক্ষ থেকে একতরফা কোনো কার্যক্রম হলে তা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা প্রটোকল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। বাংলাদেশের সরকারের লিখিত অভিযোগ ও প্রতিবাদ থাকা সত্ত্বেও, ঘটনা ঘটার পরে প্রমাণ সংগ্রহ, দস্তাবেজ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত নথিভুক্তি জরুরি। বিজিবিকে সীমান্ত তল্লাশি ও নথিভুক্তি জোরদার করতে হবে যাতে প্রতিটি ঘটনার প্রামাণ্য রেকর্ড থাকে আন্তর্জাতিক সংসদ, ইউএন, ইউনিভার্সাল মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে উপস্থাপনা করার জন্য।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এ ছাড়াও রয়েছে : অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ট্রানজিট সুবিধা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা- এসবই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। সীমান্তনীতি যদি কেবল রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তাহলে আঞ্চলিকভাবে ফের উদ্বেগ ও উত্তেজনা দেখা দেবে। ১৯৪৭ সালের বিভাজনের পুরনো দাগগুলো আবার নতুন করে তীব্র হতে পারে ভাষা, ধর্ম ও পরিচয়ভিত্তিক বিভাজনের নাট্য একই রূপে ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
হালনাগাদ পদক্ষেপ হিসেবে কী করা উচিত? প্রথমত, বাংলাদেশকে প্রতিটি ঘটনার ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও প্রামাণ্যকরণ চালিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক চ্যানেল সক্রিয় রেখে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছ ও যাচাইযোগ্য প্রক্রিয়া স্থাপনে চাপ বাড়াতে হবে সুবিধাভিত্তিক নয়, আইনিভিত্তিক প্রত্যাবাসন প্রটোকলের নিশ্চয়তা চাওয়া উচিত। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিশেষত জাতিসঙ্ঘ ও ইউএনএইচআরসিকে জড়িত করে নিরপেক্ষ তদন্ত ও নিরীক্ষার দাবি তুলতে হবে।
সীমান্ত শিল্প নয়; এটি মানুষের জীবন ও মর্যাদার সীমা। বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা যদি সত্যিকারের হয়, তবে সীমান্তের নরম মানবিক রীতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত। নয়াদিল্লি যদি আঞ্চলিক নেতৃত্ব বা মুসলিম-হিতে নীতিনির্ধারণের দাবি করে, তবে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তার নীতিগত ভিত্তি হবে না হলে সেই দাবি শূন্যচেতন থাকবে। শেষমেশ, সীমান্তনীতির হিউম্যানিটি ফেরানো না হলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ছড়িয়ে পড়া ‘পুশইন’ কার্যক্রম কেবল অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে দ্বিপক্ষীয় আস্থা, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সার্বভৌমতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। যাচাই-বাছাই ও আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে ন্যূনতম কূটনৈতিক প্রক্রিয়া ছাড়া মানুষকে জোরপূর্বক সীমান্তে ঠেলে দেয়ার ঘটনায় অনেকেই প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক ও নিবন্ধিত শরণার্থী আত্মসত্তা ও নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন। সমস্যার সমাধান করতে বাংলাদেশের প্রয়োজন পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমাণ সংগ্রহ, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ ও স্বচ্ছ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা। সীমান্ত নীতিতে মানবিকতা ও আইনের শ্রদ্ধাই ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতার মূল চাবিকাঠি।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ‘পুশইন’ কেবল সীমান্ত নীতি নয় এটি মানুষের অধিকার ও দ্বিপক্ষীয় আস্থাকে ভাঙছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া জোর করে ঠেলাধাক্কা, নিবন্ধিত শরণার্থীরও অনানুষ্ঠানিক প্রত্যাহার সবই আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক নীতির পরিপন্থী। ঢাকাকে প্রমাণ সংগ্রহ, কূটনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জোরদার করতে হবে। নিরাপত্তার মোড়কে মানবিকতা হারালে সীমান্তই নয়, সম্পর্কও ভাঙে।