পতিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে নাশকতার মিশনে নেমেছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় প্রায় প্রতিদিন ঝটিকা মিছিল করার মধ্য দিয়ে নতুন করে তাদের শক্তিমত্তা জানান দিচ্ছে দলটি। এদিকে ছক বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষ বার্তা দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে আগামী ১৩ তারিখ রায় ঘোষণার দিনক্ষণ নির্ধারণ করার কথা রয়েছে। ওই দিন আদালত যাতে রায়ের তারিখ ঘোষণা করতে না পারে সেজন্য নানা হুমকি ধমকিসহ সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে তৎপরতা চালাচ্ছেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। পতিত দলটির শীর্ষ পর্যায়ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা থেকে কলকাঠি নাড়ছেন বলে জানা গেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে নিরাপদে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে পতিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ও সরকারের মন্ত্রিপরিষদসহ আওয়ামী লীগের পুরো বডি আত্মগোপনে চলে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পতিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা জুলাই গণহত্যার দায় মাথায় নিয়ে ভারতের দিল্লিতে অবস্থান করছেন। সেই সাথে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি বড় অংশসহ ক্ষমতাচ্যুত দলটির এমপি-মন্ত্রীর একটি বড় অংশ মিলে অন্তত দুই হাজার জনশক্তি ভারতের কলকাতার নিউটাউন, ইডেন গার্ডেন ও তার আশপাশে অবস্থান করছেন। এদিকে ৫ আগস্ট বিতাড়িত হওয়ার পর পলাতক নেতাকর্মীরা সর্বত্র কোণঠাসা হয়ে পড়েন। যদিও রাজনৈতিক নানা মেরুকরণে এক বছরের মাথায় ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন পতিত দলটির নেতাকর্মীরা। কেউ ইউটিউব চ্যানেলে, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ ছোট পরিসরে ঝটিকা মিছিল নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন অলিতে গলিতে সক্রিয় অবস্থান জানান দিচ্ছেন দলটির তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে হাইকমান্ডের নেতৃত্ব। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে পতিত দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব কলকাতায় বসেই সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে নাশকতার ছক বাস্তবায়নে কঠোর নির্দেশনা দিচ্ছেন। সেই নির্দেশনা পেয়ে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তারা ব্যানারে লিখছেন- ‘শেখ হাসিনা আসছে, বাংলাদেশ হাসছে’ ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’- এ ধরনের নানা স্লোগানের মাধ্যমে কয়েক মিনিটের মধ্যে ঝটিকা মিছিল দিয়ে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে এবং মিছিল শেষে গ্রেফতারের ভয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে তারা সটকে পড়ছেন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে হুমকি দিয়ে পতিত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ইউটিউব চ্যানেল দ্য রিপাবলিক এক্সপ্রেস ও নতুন সময়কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘উন্নয়নের রোল মডেল শেখ হাসিনার নামে মিথ্যা ভিত্তিহীন বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দিয়ে অবৈধ ইউনূস সরকারের অবৈধ অস্থায়ী আদালত মামলার নাটক মঞ্চস্থ করে মামলার রায়ের দিন নির্ধারণের জন্য ১৩ তারিখ ধার্য করেছে। ওই দিন মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, ৮৫ ভাগ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় যিনি রয়েছেন অবৈধ সরকারের অবৈধ অস্থায়ী আদালত কোনো রায় দিয়ে রায় চাপিয়ে দেবে বাংলার জনগণ তা মেনে নেবে না। আগামী ১৩ তারিখ সকাল সন্ধ্যা লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছি।’ অন্তর্বর্তী সরকারকে হুমকি দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘এরপরও যদি চৈতন্যবোধের উদয় না হয় তাহলে বলে দিচ্ছি, ইউনূস সাহেব এরচেয়ে আরো বড় কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’ এদিকে আরেকটি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা এবং অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন পতিত আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে অতীতের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন করছে এবং গ্রেফতার করে, মামলা-হামলা দিয়ে হয়রানি করছে। বিশেষ করে জুলাই গণহত্যার দায়ভার শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নির্বাচনের আগে দ্রুত বিচার করার ব্যবস্থা করছে, যাতে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। পতিত আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় এও মনে করছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন আওয়ামী লীগ এদেশে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন না এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা কোনোদিন দেশে ফিরতে পারবে না। এমনকি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার থাকলে শেখ হাসিনার বিচার দ্রুত ত্বরান্বিত হবে- যেটা আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য একদিকে লজ্জার অন্যদিকে হুমকিস্বরূপ। এমন প্রেক্ষাপটে যেকোনো পরিস্থিতিতে হোক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যাতে সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্যক্রম শেষ করতে না পারে সেজন্য লকডাউনসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে এবং নাশকতার ছক বাস্তবায়নের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এজন্য নানা ইস্যু তৈরি করার জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্যও কোটি কোটি টাকা লগ্নি করা হচ্ছে।
ঢাকার মধ্যম সারির এক নেতা আলাপকালে বলেন, আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতার চিন্তা বাদ দিয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বিচারকার্যক্রমকে নিয়ে বেশি চিন্তিত। আদালত যদি শেখ হাসিনার রায় ঘোষণা করতে পারে তাহলে আগামী নির্বাচনও করে ফেলতে পারবে। এজন্য দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো করা হচ্ছে। ১৩ তারিখ বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলার একটা চিন্তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক রমজান আলী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘১৩ তারিখ বৃহস্পতিবার লকডাউনের দিনে আমার অফিস ও বাসার আশপাশে দোকানপাট বন্ধ রাখতে বলেছি। তারা বন্ধ রাখবেন বলে কথা দিয়েছেন।’ পতিত আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের সহ স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক সামিউল বাসির সামি তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আহত বাঘের থাবা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেটা রাজাকারের দোসর ইনুস খুব শিগগিরই টের পাবে।’
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর তারা ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এখন শেখ হাসিনার বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য তারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। ভারতে পালিয়ে গিয়ে তাদের সহায়তায় আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তিনি আরো বলেন, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যে লুটপাট, দুর্নীতি, চুরিচামারি করেছে তাদের সহযোগীরা এখনো মনে করে আওয়ামী লীগ সবকিছু পারে। আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসবে। এজন্য আওয়ামী লীগ তাদের ছলচাতুরীর মাধ্যমে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাস্তায় নামাতে পারে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের কোনো ষড়যন্ত্রে পা দেয়া যাবে না।



