মুরগির গোশতে মিলছে অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহে বাড়ছে ‘সুপারবাগ’ ঝুঁকি

মো: লিখন ইসলাম, বাকৃবি
Printed Edition

গত তিন দশকে বাংলাদেশের কৃষিখাতে সবচেয়ে বড় সাফল্যের গল্পগুলোর একটি হলো পোলট্রি বা ব্রয়লার মুরগির শিল্প। এক সময়ের বাড়ির উঠানের হাঁস-মুরগি পালন এখন একটি বিশাল বাণিজ্যিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যা দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু পোলট্রি মুরগির উৎপাদনে দেশে খাদ্য জোগানে বিপ্লব ঘটলেও এর আড়ালে ঘনিয়ে আসছে ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিপর্যয়।

খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহারে মুরগির শরীরে বাসা বাঁধছে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপারবাগ’। এটা মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে এই শিল্প এখন পরিবেশের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি ‘এশিয়ান-অস্ট্রালাশিয়ান জার্নাল অফ ফুড সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি’তে প্রকাশিত এক বিশদ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এমন উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল গবেষক এই গবেষণাটি বিশ্লেষণ করেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের পোলট্রি খামারগুলো থেকে সংগৃহীত ই. কোলাই (ঊ. পড়ষর) ব্যাকটেরিয়ার নমুনার মধ্যে ৭৫ শতাংশেরও বেশি ‘মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ বা একাধিক ওষুধ প্রতিরোধে সক্ষম।

আতঙ্কের বিষয় হলো, মুরগির অন্ত্রে ‘এমসিআর-১’ (সপৎ-১) জিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা কলিস্টিন নামক অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে দেয়। উল্লেখ্য, কোলিস্টিন মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অ্যান্টিবায়োটিক।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশের মোট ব্রয়লার উৎপাদনের ৭০-৮০ শতাংশই আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের কাছ থেকে। এসব খামারিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নেন না। বরং ফিড ডিলার বা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কথায় রোগ হওয়ার আগেই ‘সুরক্ষা’ বা ‘ইন্স্যুরেন্স’ হিসেবে মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছেন। ফলে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এনরোফ্লক্সাসিন এবং টেট্রাসাইক্লিনের মতো ওষুধের ব্যাপক অপব্যবহারের ফলে মুরগির গোশতে ওষুধের অবশিষ্টাংশ থেকে যাচ্ছে, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি।

খুচরা বাজার থেকে সংগৃহীত ব্রয়লার গোশতের নমুনা বিশ্লেষণে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। নমুনার ২২ শতাংশে ফ্লোরোকুইনোলোন এবং ১৮ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিনের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে।

খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে এভাবে অল্পমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকের দীর্ঘমেয়াদি প্রবেশ অ্যালার্জি, অঙ্গ-প্রতঙ্গের সরাসরি বিষক্রিয়া এবং মানব অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি পরিবেশের ওপরও এই শিল্পের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। গবেষণার তথ্যমতে, একটি ব্রয়লার মুরগি তার জীবনচক্রে প্রায় ১.৫ থেকে ২ কেজি বর্জ্য (লিটার) ত্যাগ করে। দেশে বছরে ২০০ মিলিয়নের বেশি মুরগি উৎপাদিত হয়, যার বিপুল বর্জ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরিশোধিত অবস্থায় জমিতে বা জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানি ও নদীনালায় নাইট্রেট ও ফসফরাস মিশে পানি দূষিত করছে এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ ঘটাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সঙ্কট মোকাবেলায় ‘ওয়ান হেলথ’ বা এক স্বাস্থ্য নীতির কোনো বিকল্প নেই, যেখানে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আমাদেরকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। গবেষকরা অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে কিছু টেকসই প্রযুক্তির সুপারিশ করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক, অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প কার্যকরী ভেষজ ওষুধ রয়েছে। এ ছাড়া বায়োসিকিউরিটি জোরদারকরণ, টিকাদান নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খামারিদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ, অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ বিক্রয় বন্ধ করতে কঠোর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, গবেষকদের টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন, নিরাপদ ও টেকসইভাবে উৎপাদিত মুরগির গোশতের চাহিদা ভোক্তা নিশ্চিত করতে হবে।

গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক অধ্যাপক ড. মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্রয়লার শিল্প আমাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করছে, লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক সঙ্কট এই অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। সময় থাকতে আমরা যদি সচেতন হই এবং ‘ওয়ান হেলথ’ নীতির সমন্বিতভাবে কাজ করি, তাহলে এই শিল্পকে একটি নিরাপদ, লাভজনক ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারব।