২৪ সালের সিইসির ভাই, ২৬ সালের পুলিশের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ সমন্বয়ক!

গোপালগঞ্জ সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততায় প্রশ্ন পুলিশ বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়ে

এ নিয়োগের খবরে পুলিশের ভেতরেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করছেন, এভাবে প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হলে তা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের গোপন এজেন্ডার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষিত ‘স্বপ্নের মডেল নির্বাচন ২০২৬’-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আগামীকাল ৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ২০২৪ সালের বিতর্কিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাই পুলিশ কর্মকর্তা কাজী জিয়াউদ্দিন বিপিএম। আর প্রশিক্ষণের সাচিবিক ও কারিগরি দায়িত্বে আনা হয়েছে আওয়ামী আমলে গোপালগঞ্জভিত্তিক সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুন বিপিএম, পিপিএম।

এ নিয়োগের খবরে পুলিশের ভেতরেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করছেন, এভাবে প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হলে তা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের গোপন এজেন্ডার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে। বিষয়টি একাধিক সূত্র নিশ্চিত করলেও, তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

প্রশিক্ষণের কাঠামো : বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়াম, রাজারবাগে সব জেলার পুলিশ সুপার, মেট্রোপলিটন কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও ডিপিসহ- প্রথম ধাপে আনুমানিক ১৫০ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন। পুলিশ প্রধান আইজিপি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দিকনির্দেশনা দেবেন। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনের আগেই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রশিক্ষণের ঘোষিত উদ্দেশ্য- গত তিনটি নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে দূরে থেকে পুলিশ বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম করা।

বিতর্কিত নিয়োগের ইতিহাস : এ ধরনের ব্যাপক আয়োজনে প্রশ্ন উঠছে প্রশিক্ষণের প্রধান সমন্বয়কের নিয়োগ নিয়েই। কাজী জিয়াউদ্দিন অতীতে সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের পিএস, দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত এ কে এম শহিদুল হকের আমলে টেলিকম ও সদর দফতরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’-এর সময়ে অপারেশন শাখার দায়িত্ব এবং সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের আমলে মানবসম্পদ শাখায় আওয়ামী দলীয় নিয়োগ প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি ২০২৪ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে তিনি প্রায়শই কমিশনে যাতায়াত করে পদায়ন ও বদলির গোপন সমন্বয় করেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

অপর দিকে, মাহফুজুর রহমান আল মামুনকে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত করা হয়। সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশে তিনি সিন্ডিকেটভুক্ত কর্মকর্তাদের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তার গোপালগঞ্জ সংযোগ, আওয়ামী সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনে আইন সম্পাদক হিসেবে একাধিকবার দায়িত্ব পালন, ফেসবুকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রশংসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থী ছাত্র রাজনীতির সম্পৃক্ততা- সব মিলিয়ে তাকে আওয়ামী ঘরানার সুবিধাভোগী কর্মকর্তা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।

প্রশ্ন ও সংশয়

পুলিশের অভ্যন্তরে বহু কর্মকর্তা মনে করছেন, দীর্ঘদিন বঞ্চিত ও দক্ষ কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করে বিতর্কিত অতীতের ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়ায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত মডেল নির্বাচনের লক্ষ্য ও জনগণের প্রত্যাশা এই প্রক্রিয়ায় ভেস্তে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন-“দীর্ঘদিন বঞ্চিত পেশাদার কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করে এ ধরনের রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া নির্বাচনী প্রশিক্ষণের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”

কর্মকর্তাদের মতে, প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া এভাবে পরিচালিত হলে তা আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

বিভিন্ন মহল মনে করছে, বাংলাদেশ পুলিশের এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আসলেই যদি নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতি হয়, তবে এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও তদন্ত এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।