রাজধানীর অভিজাত এলাকা খ্যাত গুলশান-বনানীর লেকগুলো এখন ওই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য গলার কাটা হয়ে উঠেছে। লেক ভিউ বাসা নির্মাণ বা ফাটে বাস করতে গিয়ে এখন দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়েছে তাদের। বিশেষ করে রোদের তেজ একটু বাড়লেই ঝাঁঝালো গন্ধ এসে নাকে লাগছে। লেক পাড় দিয়ে হাঁটতেও তখন নাকে রুমাল দিতে হয়। লেকগুলোর মালিকানা রাজউকের হলেও গুলশান-বনানী সোসাইটি মাঝে মাঝে উপরের ভাসমান ময়লা পরিষ্কার করে থাকে। কিন্তু এভাবে পানির দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি দিতে পারছে না তারা। এলাকার বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আমরা নিয়মিত কর পরিশোধ করি। একটি অভিজাত এলাকায় বাস করেও এভাবে দিনের পর দিন দুর্গন্ধের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে এটা খুবই দুঃখজনক। তারা অবিলম্বে লেকের দুর্গন্ধ দূর ও পানির স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।
গত কয়েক দিনে গুলশান ও বনানী এলাকার লেকগুলো ঘুরে পানির উপরিভাগে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কচুরিপানা ছাড়া বাসাবাড়ির বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা লেকে ফেলা হয়েছে। বস্তায় ভরেও ময়লা ফেলা হয়েছে লেকে। যেগুলো ভাসতে দেখা যায়। এ ছাড়া পুরো পানিই সবুজ হয়ে গেছে। লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে গেলে দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগছে। যেসব পথচারী ও রিকশা আরোহী লেক এলাকা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের নাকে রুমাল দিতে হচ্ছে। লেক পাড়ে কয়েকটি বিদেশী দূতাবাসও রয়েছে। এ ছাড়া সুউচ্চ ভবনগুলো রোদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ আভিজাত্যের নিচেই রয়েছে অন্ধকার। বাসা বাড়ির ময়লা পানি পাইপ দিয়ে এসে পড়ছে লেকে।
গুলশানের ব্যবসায়ী মরহুম আব্দুল কুদ্দুসের বাসার সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল হালিম বলেন, এলাকার বাড়ির ময়লা পানি পাইপের মাধ্যমে লেকে গিয়ে পড়ছে। এতে সবসময় পানিতে দুর্গন্ধ থাকছে। বিশেষ করে যখন রোদ বাড়ে তখন গন্ধও বেশি আসে। এক রকম ঝাঁঝালো গন্ধে তখন লেক পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে যায়।
গুলশান সোসাইটির নিয়মিত পরিচ্ছন্নকর্মী আব্দুর রহমান বলেন, লেকের ময়লা অপসারণের জন্য তারা মোট ২৬ জন কর্মী আছেন। আমরা নিয়মিত কচুরিপানাসহ পানির উপরের ময়লা পরিষ্কার করি। কিন্তু প্রতিনিয়তই লেকে ময়লা জমা হয়। আবার পানির রঙও সবুজ হয়ে গেছে। এজন্য মাঝে মধ্যে ব্লিচিং পাউডার দেয়া হয়, কিন্তু সেটা নিয়মিত না।
বনানী এলাকার বাসিন্দা নুরুল হক বলেন, লেক ভিউ দেখে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। এখন দেখছি, বড় বিপদে পড়েছি। এত দুর্গন্ধ যে তা বলার মতো নয়। রাতে ঘুমাতে গেলেও নাকে দুর্গন্ধ লাগে। গত ৮ সেপ্টেম্বর বনানী সোসাইটির সভাপতি শওকত আলী ভুঁইয়া দিলন লেকের পানির দুর্গন্ধ এবং পরিবেশ দূষণ রোধে উদ্যোগ নিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন। এতে তিনি বলেন, সম্প্রতি বনানী লেকের পানির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, যা আশপাশের পরিবেশকে অত্যন্ত দুর্গন্ধময় এবং বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে।
নয়া দিগন্তকে তিনি বলেন, লেকের মালিক রাজউক। লিখিত আবেদন জানানোর পরও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং আমরা কিছু উদ্যোগ নিলেও তারা সেটিতে বাধা দিচ্ছে। জানা যায়, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গুলশান সোসাইটিকে দায়িত্ব দেয় রাজউক। এজন্য ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর রাজউক ও গুলশান সোসাইটির মধ্যে পৃথক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এর ফলে রাজউকের পক্ষ থেকে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় গুলশান সোসাইটি। এ ছাড়াও রাজউকের মালিকানাধীন গুলশান লেক পার্ক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও সোসাইটির ওপর অর্পিত হয়।
সোসাইটির সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর সাদাত নয়া দিগন্তকে বলেন, মূলত আশপাশের বাড়ির পয়ঃবর্জ্যরে লাইন সব লেকে গিয়ে পড়েছে। এ কারণে পানি দুর্গন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দাশেরকান্দিতে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করা হলেও বাসাবাড়ির ময়লা ওই শোধনাগারে নিতে কোনো লাইন নির্মাণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ নয়া দিগন্তকে বলেন, লেকের মালিক রাজউক। আর ময়লা পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। তারপরও আমাদের পক্ষ থেকে বাসাবাড়ির ময়লা যাতে দাশেরকান্দিতে নিয়ে যাওয়া যায় সেজন্য পাইপ লাইন নির্মাণে বিশ^ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার সাথে কথা বলে দুটি প্রকল্প গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন আছে। ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে ঢাকা ওয়াসা। নাগরিকদের সমস্যা সমাধানে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজু নয়া দিগন্তকে বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকার লেকগুলোর ময়লা-আবর্জনার সমস্যা দীর্ঘদিনের। আশপাশের লোকজনই লেকে ময়লা ফেলছে। হাতিরঝিল নিয়েও বিরাট সমস্যায় আছি। আমরা এ সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার সাথে যৌথভাবে কাজ করছি। আগামী বৃহস্পতিবারও রাজউকে এ বিষয়ে একটি যৌথসভা রয়েছে। আশা করি সমাধান হবে।