১৪ দেশে ব্রি উদ্ভাবিত ২৩ জাতের ধান চাষ

আধুনিক ধান চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের

মো: আজিজুল হক, গাজীপুর মহানগর
Printed Edition
ব্রি উদ্ভাবিত ধান
ব্রি উদ্ভাবিত ধান |সংগৃহীত

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত আধুনিক ধানের জাত মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের ফলে বর্তমানে দেশে বছরে ৬.৬ লাখ টন হারে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্ভাবিত এসব জাতের চাষাবাদ পদ্ধতি ও প্যাকেজ কৃষকপর্যায়ে সমাদৃত হওয়ায় দেশে চালের উৎপাদন প্রায় ৪০.৭০ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। এমনকি ব্রি উদ্ভাবিত ২৩টি জাতের ধান বর্তমানে ভারত, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ভূটান, ঘানা, গাম্মিয়া, সিনেগাল, সিয়েরা লিওন, ইরাকসহ বিশ্বের ১৪টি দেশে চাষ হচ্ছে।

আধুনিক ধান চাষের জন্য ব্রি ৩০০ এর অধিক রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা, পরিবর্তিত জলবায়ুবান্ধব বিভিন্ন প্রযুক্তি ও কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছে। মাটি, পানি ও সার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০০টির বেশি উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের প্রথম জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান ব্রি ধান৬২সহ ৭টি জিঙ্ক সমৃদ্ধ জাত ও প্রিমিয়াম গুণসম্পন্ন রফতানিযোগ্য ১৪টি, এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ধান, ডায়াবেটিক ধান এবং প্রোভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইসের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে ব্রি। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে Rice vision 2050 and beyond প্রণয়ন করেছে; যাতে ২০৩০, ২০৪১ এবং ২০৫০ সালে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে চালের উৎপাদন প্রক্ষেপণ করা হয়েছে এবং তা অর্জনে ব্রি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাফল্য ও অর্জন শীর্ষক প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এ পর্যন্ত ইনব্রিড জাতের ১১০টি ও হাইব্রিড জাতের ৮টি মোট ১১৮টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, লবণাক্ত সহনশীল ১২টি, জলমগ্নতা সহনশীল ৪টি, জলমগ্নতা ও লবণাক্ত উভয় সহনশীল ১টি, খরা সহনশীল ৪টি, জোয়ার-ভাটা সহনশীল ৫টি, ঠাণ্ডা সহনশীল ৪টি, প্রিমিয়ার কোয়ালিটির ১৪টি, জিংক সমৃদ্ধ ৭টি, আউশ মওসুমের জন্য ১৫টি এবং অনুকূল পরিবেশের জন্য ৮১টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। ব্রি ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে Doubling rice productivity in Bangladesh by 2030 শীর্ষক কৌশলপত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। আধুনিক ধান চাষের জন্য ব্রি ৩০০ এর অধিক রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা, পরিবর্তিত জলবায়ুবান্ধব বিভিন্ন প্রযুক্তি ও কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছে। মাটি, পানি ও সার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০০টির বেশি উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও কৃষকপর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ মোতাবেক ধানের উৎপাদন ও রোগবালাই দমনে ন্যানো ফার্টিলাইজার ও ন্যানো পেস্টিসাইডের প্রভাব নিয়ে ব্রিতে ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে চাষের উপযোগী, বৈরী পরিবেশ সহিষ্ণু (যেমন- বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জোয়ারভাটা, জলমগ্নতা, নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রা) অধিক অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন, অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং ক্ষতিকর পোকামাকড়-রোগবালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে বিদ্যমান প্রযুক্তির পাশাপাশি অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তি যেমন- মলিকুলার মার্কারের ব্যবহার, জিনোম এডিটিং (CRISPR-Cas9) ব্যবহৃত হচ্ছে। ধানের ফলন আরো বাড়ানোর জন্য সি৩ ধান কে সি৪ ধানে রূপান্তরে গবেষণা চলছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ সত্ত্বেও ধানের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন ব্রি বিজ্ঞানীরা, যা ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার চাষি ইঞ্জিনিয়ার আফজাল হোসেন বলেন, কাপাসিয়া অঞ্চলে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের জাতের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সময়মতো বীজগুলো পাওয়া যায় না। এটি কৃষক ভাইদের জন্য প্রধান সমস্যা। নির্ধারিত মৌসুম শুরুর আগেই কৃষকের কাছে ধান গবেষণার বীজ সরবরাহ করতে পারলে এ এলাকায় ব্যাপকভাবে ধান গবেষণার জাত আবাদ হতো।

ব্রি মহাপরিচালক ড. মুহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্রি বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি বছর ১৫০ টনের অধিক ব্রিডার বীজ উৎপাদন এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকের কাছে মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রি-তে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মোট ৩টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত যথা- ব্রি ধান১০৯, ব্রি ধান১১০ ও ব্রি ধান১১১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমন মওসুমের জন্য উদ্ভাবিত ব্রি ধান১০৯ এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো জাতটি জোয়ার-ভাটা সহনশীল, Amylose ২৫.৪% এবং ফলন প্রতি হেক্টরে ৬ টন। আমন মওসুমের জন্য উদ্ভাবিত ব্রি ধান১১০ এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো জাতটি জলমগ্নতা ও লবণাক্ত উভয় সহনশীল, ফলন হেক্টরে ৬ টন যা বিনা ধান১১ এর চেয়ে ফলন শতকরা ২০ ভাগ বেশি। আমন মওসুমের জন্য উদ্ভাবিত আলোক সংবেদনশীল জাত ব্রি ধান১১১ এর উলেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো জাতটি মধ্যম মাত্রার গভীর পানি সহনশীল, Amylose ২৭.৫%, ফলন হেক্টরে ৪.২ টন যা ব্রি ধান৯১ এর চেয়ে হেক্টর প্রতি ১ টন বেশি। এ ছাড়াও আরো ৩টি ইনব্রিড ধানের জাত (প্রস্তাবিত ব্রি ধান১১২, প্রস্তাবিত ব্রি ধান১১৩, প্রস্তাবিত ব্রি ধান১১৪) উদ্ভাবনের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ডে অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন। লবণাক্ততা সহনশীল আরো ২টি হাইব্রিড ধানের জাত (ব্রি প্রস্তাবিত ব্রি হাইব্রিড ধান৯, প্রস্তাবিত ব্রি হাইব্রিড ধান১০) নিবন্ধনের জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সীতে পরীক্ষাধীনে রয়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তি সম্প্রসারণে ব্রির বিদ্যমান ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পাশাপাশি আরো নতুন ৬টি আঞ্চলিক কার্যালয়সহ ৬টি স্যাটেলাইট স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্ধশতাধিক বিভিন্ন ধরনের খামার যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করা হয়েছে।