চলচ্চিত্রের এক সময়কার আঁতুড়ঘর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) লোকশনের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে বছরে মাত্র চার কোটি আয়ের বিপরীতে ব্যায় হয়েছে ১৯ কোটি। ব্যয়ের পরিমাণ আয়ের প্রায় পৌনে চার গুণ বেশি। তবে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দাবি তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে ব্যয় কমেছে।
সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলছেন এটি এখন রাষ্ট্রের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অব্যবস্থাপনা, অপ্রতুল আধুনিকায়ন, জরাজীর্ণ পরিবেশ এসব কারণে ঝলমলে রুপালী অতীত হারিয়ে এটি এখন চলচ্চিত্রের উন্নয়নের পরিবর্তে বাধা হয়ে কাজ করছে। বিগত ১৬ বছরে এর আধুনিকায়নে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির প্রকট অভাব। স্টুডিওগুলো জরাজীর্ণ এবং সরঞ্জাম অপ্রতুল ও পুরনো। ফলে শুটিং ও ডাবিংয়ের কাজ হয় না বললেই চলে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছেন, তা রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। হয়তো এক সময় এ সঙ্কট কেটে যাবে।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী মাত্র দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে ৯ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার ৩৩৩ টাকা। আর একই সময়ে ব্যায় হয়েছে ৪৮ কোটি ৪৮ লাখ ৩৩ হাজার ১৬৩ টাকা। সে হিসেবে মাত্র দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে আয়ের চেয়ে ব্যয় হয়েছে ৩৮ কোটি ৬৬ লাখ ২৪ হাজার ৮৩১ টাকা।
এফডিসির হিসাব শাখার তথ্যানুযায়ী, করপোরেশন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও সেবা খাত থেকে ছয় কোটি ২৪ লাখ ৭৪ হাজার ৫৫৭ টাকা ২১ পয়সা আয় করেছিল। সেই বছর বিভিন্ন খাতে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭৬৩ টাকা ৮০ পয়সা। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ খরচ হয়েছে ৩৪ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৪ টাকা।
পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে করপোরেশন আয় করেছে তিন কোটি ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭৭৫ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ২৪ কোটি ৪৮ লাখ ৬৮ হাজার ৪০২ টাকা ৫০ পয়সা। ঘাটতির বাকি টাকা আনতে হয় সরকারের কাছ থেকে।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাড়ে সাত একর জায়গার ওপর এফডিসির এই প্রধান কার্যালয়। আগে এখানে ছিল ৯টি শুটিং ফ্লোর, পুকুর, বাগান, সুইমিংপুল, কৃত্রিম ঝরনা, জমিদারবাড়ি এবং নানা শুটিং স্পট। কিন্তু এখন শুটিংয়ের উপযুক্ত স্থান বলতে রয়েছে কেবল প্রশাসনিক ভবনের সামনে আর ঝরনা স্পটের আশপাশের খোলা জায়গাটুকু। অন্য সবগুলো প্রায় অকার্যকর।
হিসাব বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে কর্মীদের বেতনভাতা, গ্র্যাচুইটি মিলিয়ে এফডিসি অনুদান পেয়েছে ৩১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, এ সময়ে ৪৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ঋণও করতে হয়েছে। তার মানে এক দশকে সরকারের অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে ৮০ কোটি ১৩ লাখ টাকা নিতে হয়েছে এফডিসিকে।
উৎপাদন বিভাগের রেট কার্ড অনুযায়ী, সংস্থাটির আয়ের উৎস হচ্ছে স্পট ভাড়া (সেট নির্মাণ ও শুটিংকালীন)। এই স্পটের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ফ্লোর, স্টুডিও চত্বর, কড়ইতলা, এডিটিং মাঠ, বাগান, ক্যান্টিন, গ্যারেজ, ভবনের ছাদ, স্টল, লবি, করিডোর, মেডিক্যাল সেন্টার, ঝরনা স্পট, ভিআইপি প্রজেকশন হল, কালার ল্যাবে শুটিং।
তা ছাড়া রয়েছে ক্যামেরার যন্ত্রপাতি, লাইট ভাড়া, সেট ম্যাটেরিয়াল, এডিটিং চার্জ, শব্দ, টেলিসিনে মেশিন, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, ফুল, ল্যাবরেটরি ও কবিরপুর ফিল্ম সিটি। এসব ভাড়াও আয়ের উৎসে যুক্ত হয়। কিন্তু অধুনিক প্রযুক্তির যুগে এগুলোর প্রয়োজন কমে যাওয়াতে তা থেকেও আয় কমে গেছে।
তবে এফডিসি ঘুরে দেখা গেছে, আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়েছে। নতুন এমডি মাসুমা তানি আসার পর আগের ভুতুড়ে এফডিসি আর নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাও স্বাভাবিক হয়েছে। প্রতিটি ফ্লোরে শুটিংয়ের ব্যস্ততা বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে এমডির প্রাণপণ চেষ্টার কথাও বলছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে গতকাল এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নয়া দিগন্তকে বলেন, এ ব্যয় আগে হলেও এখন হিসাব পাল্টে গেছে। ব্যয় আগের চেয়ে কমেছে। তবে কী পরিমাণ কমেছে তা তিনি তাৎক্ষণিক বলতে পারেননি।
সম্প্রতি তিনি এফডিসির সমস্যার কথা তুলে ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে এফডিসির ক্যামেরা ও লাইট, শব্দ, এডিটিং শাখা, ফ্লোর ও সেট সবই অনেক পুরাতন, যা বর্তমান সময়ে কাজের সাথে মানানসই নয়। সর্বশেষ ১৬ সালে তারা যন্ত্রপাতি পাওয়ার পর আর নতুন কোনো কিছৃ কেনা হয়নি। ফলে বর্তমান অবস্থায় এ থেকে আয় নেই বললেই চলে।
এফডিসিতে বর্তমানে কাজের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে ৮টি ক্যামেরা সনি এফ-৫৫ মডেল, রেড ড্রাগন, রেড স্কারলেটের মধ্যে এখন শুধু সচল আছে সনি এফ-৫৫ মডেলের তিনটি ক্যামেরা। অন্যগুলো নষ্ট, তবে মেরামতযোগ্য।
এ ছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য ৫ দশমিক ১ সাউন্ড সিস্টেম সফটওয়্যার নষ্ট অনেক বছর ধরে। ডাবিং মেশিন নষ্ট, সাউন্ড মিক্সিংয়ের দুইটি মেশিন ছিল সেগুলো অনেক আগে থেকেই নষ্ট। ৫.১ বা ৭.১ সারাউন্ডিং সাউন্ড সিস্টেম নেই।
আর ফ্লোরগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, বিএফডিসি কমপ্লেক্স তৈরি করার জন্য তিনটি ফ্লোর ভেঙে ফেলা হয়েছে। অন্য ৮ ও ৯ ফ্লোর মোটামুটি ভালো আছে। অন্য ফ্লোরগুলো সংস্কার করতে হবে। যেগুলো আছে সেগুলোতেও পানি পড়ে, কোনোটাতে এসি নষ্টসহ। এ ছাড়া এডিটিং শাখার মেশিনগুলো অচল, এডিটিং তো সফটওয়্যারের মাধ্যমে, এগুলো ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। ডিসিপি (ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ) মেশিন নষ্ট। ক্রিস্টি প্রজেক্টর মেশিন কোনো কাজে লাগেনি। ভিজ্যুয়াল এফেক্টের কাজের সুবিধা নেই। ২০০৭ সাল থেকে ডিজিটাল সাউন্ড ইকুইপমেন্টের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল; কিন্তু সেগুলো মামলা ঝামেলায় ব্যবহার করা হয়নি। এগুলো এখন অকেজো, ব্যবহারযোগ্য নয়। দুইটি জিমি জিব ক্রেইন (৪০ ফুট) থাকলেও তা চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই।
তার ভাষ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনভাতা, গ্রাচুইটি, ব্যাংক ঋণের সুদসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে এফডিসির আর আয়ের কোনো অর্থ থাকে না। মাস শেষে ব্যয় পরিশোধে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি, লজিস্টিক সাপোর্ট আর দক্ষ লোকবল পেলে এফডিসি থেকে আগের মতো আয় করা সম্ভব হতো। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা মিলছে না। ফলে আয়ের সাথে ব্যয় সঙ্কুলান অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এফডিসির তথ্যানুযায়ী, ১৯৫৭ সালে যাত্রা করা সংস্থাটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সর্বোচ্চ রাজস্ব দিয়েছিল ১৯৯৯-২০০০ সালে; যার পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। তবে এরপর থেকেই রাজস্ব দেয়ার পরিমাণ কমতে থাকে। আর ২০১৬ সাল থেকে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।



