রুশ তেল কেনা অব্যাহত রাখায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর আরো শুল্ক বৃদ্ধির আভাস দিয়েছেন। বিষয়টি নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আলাস্কায় ট্রাম্প ও পুতিনের বৈঠকের সফলতার ওপর। দুর্ভাগ্যবশত বৈঠকের ফলাফল শূন্য। কোনো চুক্তি হয়নি। আলজাজিরার বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ট্রাম্প ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথে, আমেরিকা কি এশিয়ার প্রতি তার মূল ভূমিকা ত্যাগ করছে? ট্রাম্পের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় এশিয়ার মার্কিন অংশীদাররা, যেমন ভারত, তাদের নিজস্ব পরিবর্তনের কথা ভাবতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সহজ হবে না।
আলাস্কায় ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যকার বৈঠক কেবল ইউরোপ এবং ইউক্রেন নয়- বরং ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে নয়াদিল্লি তা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের প্রতি মার্কিন উষ্ণতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি হিসেবে নয়াদিল্লির উপর তাদের বাজি, কারণ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কৌশলগত শক্তি নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটন ও দিল্লি একমত ছিল। কোয়াডের মত জোটের অংশ হিসেবে চীনের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানও সক্রিয় ছিল। কিন্তু ওবামা আমেরিকা এবং ভারতকে ‘সেরা অংশীদার’ হিসাবে বর্ণনার এক দশক পরে, এখন তা অন্য কিছু বলে মনে হচ্ছে।
লক্ষণীয় চীন ভারতের চেয়েও বেশি রুশ তেল ক্রয় করেও আপাতত উচ্চ মার্কিন শুল্ক থেকে মুক্তি পেয়েছে, এই বৈপরীত্য একদিকে চীনের প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্য দিকে ভারতের মতো ঐতিহ্যবাহী বন্ধুর মাঝখানে কোনো বড় ধরনের সম্পর্ক পরিবর্তন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ভারত এবং মোদির জন্য সমস্যা
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মিলান বৈষ্ণব বলেছেন, শুল্ক পদক্ষেপগুলো কয়েক দশকের মধ্যে মার্কিন-ভারত সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুতর ফাটল সৃষ্টি করায় পরিস্থিতি বদলে গেছে, পাল্টা ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভণ্ডামির অভিযোগ এনে বলেছে তারা এখনও রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করে। বৈষ্ণব আরো বলেন, একটি বিষয় স্পষ্ট যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দুটি দেশেরই একে অপরের উপর আস্থা তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক প্রবীণ দোন্থির কাছে, সম্পর্কের সঙ্কট মোদি এবং ট্রাম্পের মধ্যে ব্যক্তিগত সমীকরণের একটি নাটকীয় মোড়কেও প্রতিফলিত করে যা তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের ফলাফল। অথচ ভারত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার পরও প্রস্তাবিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল। তবে, এখন, ভারতের বহু নীতি ট্রাম্পের ভূ-রাজনীতির লেনদেনমূলক পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক।
দোন্থি বলেন, নিশ্চিতভাবেই, পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাসের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ‘ভারতের কৌশলগত আকাশে আমেরিকার প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস গেঁথে গেছে’। পাকিস্তানের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক সৌহার্দ্য, যার ফলে এই বছর তার সেনাপ্রধানের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর, এমনকি হোয়াইট হাউজের সাথে একটি বিরল সাক্ষাৎ, সম্ভবত নয়াদিল্লির উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে তুলবে। কারণ এর আগে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত গুরুত্বের কারণে, বিশেষ করে চীনের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে, ভারত সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট দ্বিদলীয় ঐকমত্য বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ ভারতের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত পরোপকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাহত করেছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় অংশীদারদের কাছে এখন আর স্পষ্ট নয় যে ওয়াশিংটন তাদের অঞ্চলে জোট গঠনের দিকে ততটা মনোযোগী কি না যতটা তারা একসময় বলেছিল। প্রবীণ দোন্থির মতে ‘বর্তমানে মন্থন এবং অনিশ্চয়তার একটি সময় চলছে, যার পরে সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্পষ্টতা বেরিয়ে আসবে।’ ভারত, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো নয়, এমন কোনো দেশের সাথে কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ মিত্র ছিল না।
ট্রাম্পের শুল্ক ক্রোধের মুখোমুখি হয়ে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল মস্কো সফর করে পুতিনের সাথে দেখা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মস্কো যাওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়াও আগস্টে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের নয়াদিল্লি সফরের কথা রয়েছে। এবং মাসের শেষে, মোদি সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য চীনে যাবেন, সাত বছরের মধ্যে সেটা হবে তার প্রথম চীন সফর।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ প্ল্যাটফর্মটির পুনরুত্থানের প্রস্তাব দেয়ার পর ভারতও ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা রাশিয়া-ভারত-চীন (জওঈ) ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারতের মোদির সামনে কিছু ‘খুব কঠিন পছন্দ’ রয়েছে। ‘স্পষ্টতই, ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাবে না, কারণ রাশিয়া একটি বিশেষ অংশীদার। এবং ভারত তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে যাবে না।’ ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে আরো বেশি শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভারতের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে ভালো ফলাফল হলো যদি রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, তা না হলে ট্রাম্প রাশিয়ার উপর চাপ প্রয়োগের উপায় হিসেবে ভারতকে চাপ দেবেন।
ট্রাম্পের অধীনে এশিয়ায় ওয়াশিংটনের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের মতো দেশগুলোর জন্য এই ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হবে না। কুগেলম্যান বলেন জওঈ শেষ পর্যন্ত ‘মূল্যের চেয়ে বেশি প্রতীকী’ হবে কারণ এই ত্রিভুজের একটি দিক হলো ‘বেশ ছোট এবং ভঙ্গুর: ভারত-চীন সম্পর্ক’। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ‘উল্লেখযোগ্য উত্তেজনা হ্রাস’ হলেও, ‘ভারত এবং চীন কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে গেছে,’ এ মন্তব্য ছাড়াও কুগেলম্যান বলেন, ‘তাদের একটি দীর্ঘ বিতর্কিত সীমান্ত এখনো রয়েছে’ এবং এশীয় জায়ান্টদের মধ্যে আস্থা এখনো কম। (সংক্ষেপিত)