বিদায় আলোচিত বছর ২০২৫

আলোচনার শীর্ষে শেখ হাসিনার বিচার ও ফাঁসির রায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ফিরে আসা

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ও রূপান্তরকারী বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে ২০২৫ সাল। এ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের রায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন পুনর্বহাল, গুমের অভিযোগে সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে বিচার- সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও আইনি কাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে বিচারাঙ্গন।

আলমগীর কবির
Printed Edition

২০২৫ সাল বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ও রূপান্তরকারী বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের রায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন পুনর্বহাল, গুমের অভিযোগে সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে বিচার- সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও আইনি কাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে বিচারাঙ্গন।

এর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয়ের উদ্বোধন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের একাধিক মামলায় খালাস, নতুন প্রধান বিচারপতির নিয়োগ- এসব ঘটনাও বছরজুড়ে বিচার বিভাগকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে।

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়

জুলাই গণহত্যায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরুর পর থেকেই আলোচনার শীর্ষে ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার। দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে গত ১৭ নভেম্বর ২০২৫ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তিনটি পৃথক অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং আরো দু’টি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আদালত বলেন, তার অপরাধও মৃত্যুদণ্ডযোগ্য হলেও বিচারপ্রক্রিয়ায় সহযোগিতা ও রাজসাক্ষী হওয়ায় লঘুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়- গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ, রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা, চানখাঁরপুলে হত্যাকাণ্ড এবং আশুলিয়ায় হত্যার পর লাশ পোড়ানোর ঘটনা। শেষ তিনটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং প্রথম দুই অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়।

তিনি পলাতক থাকায় নিজে আপিল করেননি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেছে।

গুমের মামলায় সেনা সদস্যদের ট্রাইব্যুনালে বিচার

২০২৫ সালে বিচারাঙ্গনের আরেকটি বহুল আলোচিত বিষয় ছিল গুমের ঘটনায় দায়ের করা দু’টি মামলার বিচার। এর একটি মামলায় বিগত ১৫ বছরে সংঘটিত গুমের ঘটনায় বর্তমান ও সাবেক ১২ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ১৭ জনকে আসামি করা হয়। র‌্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে গুম করে রাখার অভিযোগে দায়ের হওয়া এই মামলায় দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর ট্রাইব্যুনাল আসামিদের হাজির করার নির্দেশ দেন।

২৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়। সূচনা বক্তব্যের জন্য আগামী ২১ জানুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে। মামলায় ১০ জন আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। অন্য দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সাবেক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ একাধিক আসামি পলাতক রয়েছেন।

এ ছাড়া আয়নাঘর বা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)-এ গুমের অভিযোগে দায়ের আরেক মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলাতেও ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলার বিচার কার্যক্রমও চলমান।

সুপ্রিম কোর্টে বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়

২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার ১৮ বছর পর বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়ের যাত্রা শুরু হয়। গত ১১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ভবন-৪ এ আনুষ্ঠানিকভাবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় উদ্বোধন করেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

১৯৯৫ সালে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত করার দাবিতে মাসদার হোসেন মামলার মাধ্যমে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তার পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে এটি একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি। ১৯৯৯ সালে আপিল বিভাগের রায়ের ২৬ বছর পর এই সচিবালয় গঠনের সরকারি অনুমোদন আসে গত ২০ নভেম্বর।

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ বৈধ ঘোষণা

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট খারিজ করে হাইকোর্ট রায় দেন। পরে আপিল বিভাগে দীর্ঘ শুনানি শেষে ৪ ডিসেম্বর সাত সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে লিভ টু আপিল খারিজ করে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনকে বৈধতা দেন।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলার নিষ্পত্তি

২০২৫ সালে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একাধিক মামলার নিষ্পত্তি হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার খালাসের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেয়া হয়।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তারেক রহমানের ১০ বছরের সাজা বাতিল করে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। একইভাবে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা: জুবাইদা রহমানও খালাস পান।

নতুন প্রধান বিচারপতির নিয়োগ

দেশের ২৬তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২৮ ডিসেম্বর শপথ নেন বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের অবসরের পর তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আলোচনায় হাদি হত্যার আসামির জামিন

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড এবং মূল আসামি ফয়সাল করিম মাসুদের জামিন বিচারাঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। জামিন বাণিজ্য ও বিচারব্যবস্থার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল কঠোর মন্তব্য করেন।

ফিরল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা

১৪ বছর আগে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহালের রায় দেন আপিল বিভাগ। তবে এটি ত্রয়োদশ নয়, তার পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে।

জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার ও দলের নিবন্ধন ইস্যু

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম আপিলে খালাস পান। একই সাথে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার রায় বাতিল করে নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

সার্বিকভাবে ২০২৫ সাল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জবাবদিহি এবং রাজনৈতিক ইতিহাস পুনর্লিখনের বছর হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।