অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, তাদের ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের আগে তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সাথে পরামর্শ করতে চায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মানসুর, যিনি বর্তমানে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় অংশ নিচ্ছেন, গতকাল বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
গভর্নর বলেন, আইএমএফ পরবর্তী সরকার আসার পর তাদের সাথে পরামর্শ করে পর্যালোচনা সম্পন্ন করতে চায়, বাংলাদেশ এ বিষয়ে না সম্মত, না অসম্মত। আমাদের এখন কোনো আর্থিক চাপ নেই। তাই সমস্যা হবে না। আমরা চাই নীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক।
নির্বাচনের পরেই পর্যালোচনা সম্পন্ন হবে : গভর্নর জানান, আইএমএফের আর্টিকেল-৪ মিশন অক্টোবরের শেষ দিকে ঢাকায় আসবে। তারা কর্মসূচির একটি আংশিক পর্যালোচনা করবে, তবে পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা ও বোর্ডে অনুমোদনের প্রক্রিয়া ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ নির্বাচনের পর সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে পর্যালোচনা সম্পন্ন করা যুক্তিযুক্ত নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ চায় পরবর্তী সরকার ব্যাংক খাত সংস্কার ও রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার অব্যাহত রাখার বিষয়ে লিখিত নিশ্চয়তা দিক, যেসব পদক্ষেপ ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করেছে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। পঞ্চম কিস্তি ডিসেম্বরে এবং ষষ্ঠ কিস্তি আগামী বছরের জুনে নির্ধারিত রয়েছে।
আইএমএফের শর্ত পূরণে অগ্রগতি : বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২০২৫ সালের জুনের জন্য নির্ধারিত প্রায় সব কর্মসম্পাদন সূচক ও সংস্কার লক্ষ্য পূরণ করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে নেট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা আইএমএফ নির্ধারিত ১৭.৪ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৭.৩ বিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া আইএমএফের পরামর্শে ২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি আরো নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থা চালু করে। এর ফলে ডলারের দাম, যা এক সময় প্রতি ডলারে ১২৫ টাকার উপরে পৌঁছেছিল, এখন ১২২ টাকার আশপাশে স্থিতিশীল রয়েছে।
সংস্কারে অগ্রগতি, রাজস্ব খাতে চ্যালেঞ্জ : কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ব্যাংক কোম্পানি আইন হালনাগাদ, ব্যাংক রেজুলিউশন অর্ডিন্যান্স প্রবর্তন এবং ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালা আন্তর্জাতিক মানে সমন্বয়।
তবে রাজস্ব সংগ্রহে পিছিয়ে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাজস্ব প্রশাসনকে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে সরকার সম্প্রতি এনবিআর বিলুপ্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দু’টি নতুন রাজস্ব বিভাগ গঠন করেছে যা আইএমএফের সুপারিশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির জন্য কর কাঠামোগত সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে আসছে, যা এখনো এশিয়ার মধ্যে সর্বনি¤œ পর্যায়ে রয়েছে।
নীতির ধারাবাহিকতার প্রশ্নে নির্ভর করছে কিস্তি ছাড় : অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইএমএফের এই অবস্থান সরাসরি রাজনৈতিক পরিবর্তন ও নীতিগত ধারাবাহিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করছে। নির্বাচনের পর নতুন সরকার আগের সংস্কার কর্মসূচি বজায় রাখলে কিস্তি ছাড়ে বড় কোনো জটিলতা হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাফল্য- বিশেষ করে রিজার্ভের স্থিতি, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা এবং ব্যাংক সংস্কারে অগ্রগতি আইএমএফের আস্থা ধরে রাখবে বলেও তারা মনে করেন।
নির্বাচনের আগে পরবর্তী কিস্তি বিলম্বিত হলেও, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইএমএফ কর্মসূচির অগ্রগতি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। মূল চ্যালেঞ্জ এখন কেবল- নতুন সরকারের অধীনে সংস্কারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা।



