ছাত্রদল নেতা নুরুকে বিছানা থেকে টেনে তুলে খুন করা হয় নৃশংস কায়দায়

নির্যাতন শেষে, তার মাথায় গুলি করে হত্যার পর রাউজান বাগোয়ান ইউনিয়নের খেলারঘাট কর্ণফুলী নদীর তীরে লাশ ফেলে যায় ওই হত্যাকারীরা, পরদিন ৩০ মার্চ তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

নূরুল মোস্তফা কাজী, চট্টগ্রাম ব্যুরো
Printed Edition
ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরু
ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরু |ইন্টারনেট

কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতা চট্টগ্রামের নুরুল আলম নুরুকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাতভর নির্যাতন ও গুলি চালিয়ে নৃশংস কায়দায় খুন করা হয়। পরদিন ৩০ মার্চ চোখ, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নুরুর লাশ উদ্ধার হয় রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে। এ ঘটনার সাত বছর পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর নতুন করে হত্যা মামলা দায়ের হলেও এখনো হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বেশির ভাগই ধরা ছোঁয়ার বাইরে বলে জানা গেছে।

নুরুর গ্রামের বাড়ি রাউজান উপজেলার গুজরা ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামের কমলার দীঘির পাড় এলাকায়। তাকে তুলে নেয়ার প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর নিজ বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে লাশ ‘উদ্ধার’ করে পুলিশ।

যেভাবে খুন করা হয় নুরুকে : ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাত ১১টা ৪৫ মিনিট। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার থানার চন্দনপুরাস্থ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুর বাসায় হানা দেয় পুলিশ ও তৎকালীন শাসক দলের কিছু ক্যাডার। পুলিশ দেখে নুরুর ভাগ্নে রাশেদুল ইসলাম বাসার দরজা খুলে দেন। এ সময় বাসায় ঘুমন্ত নুরুল আলমকে বিছানা থেকে টেনে তুলে হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন। নুরুর ভাগ্নে রাশেদ দাবি করেছিলেন, সাদা পোশাকে থাকা উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদবির একজন কর্মকর্তাকে তারা চিনতে পেরেছেন।

পরিবারের সদস্যদের বর্ণনানুযায়ী বাড়ির বাইরে অপেক্ষমাণ একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে করে নুরুকে নিয়ে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় রাউজানের নোয়াপাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষারত ফজলে করিমের আওয়ামী ক্যাডারদের গাড়িতে তুলে, নোয়াপাড়া পুলিশ ক্যাম্পে নুরুকে নিয়ে কাপড় দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে ও রশি দিয়ে দুই হাত আটকে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

নির্যাতন শেষে, তার মাথায় গুলি করে হত্যার পর রাউজান বাগোয়ান ইউনিয়নের খেলারঘাট কর্ণফুলী নদীর তীরে লাশ ফেলে যায় ওই হত্যাকারীরা, পরদিন ৩০ মার্চ তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

রাউজান থানার তৎকালীন ওসি মো: কেফায়েত উল্লাহ সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা একটা লাশ উদ্ধার করেছি। মাথায় গুলির চিহ্ন আছে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। হাত-পা রশি দিয়ে বাধা। তার পরনে আছে লুঙ্গি। শার্ট দিয়ে চোখ বাঁধা। মুখের ভেতর ওড়না ঢোকানো পাওয়া গেছে। পরিচয়ও আমরা নিশ্চিত হয়েছি। সে বিএনপির ক্যাডার নুরুল আলম নুরু।’

ঘটনার পর পরই পুলিশ বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করে। দুই দিন পর আদালতে নুরুল আলমের স্ত্রী সুমি আকতার মামলা করলেও সেই সময় পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। একপর্যায়ে পুলিশ নিজেদের করা মামলায় আসামি শনাক্ত করা যায়নি বলে ফাইনাল রিপোর্ট দিলে মামলাটি শেষ হয়ে যায়। গত বছরের জুলাই আগস্ট বিপ্লবের পর খুনের শিকার ছাত্রদল নেতার স্ত্রী নতুন করে সিএমপির চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করেন।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে রাউজানের সাবেক এমপি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীকে। এ ছাড়া রাউজানের নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন এসআই শেখ মুহামদ জাবেদ (৩৫), নোয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুহাম্মদ বাবুল মিয়াসহ (৫২) মোট ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩০-৪০ জনকে আসামি করা হয়।

সে সময় নুরুল আলম নুরুর স্ত্রী সুমি আকতার গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছিলেন, ‘আমার সামনে বিছানা থেকে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে তুলে নিয়ে তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়, ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। জড়িত ব্যক্তিদের ফাঁসি চাই।’

এ দিকে নুরু হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই নুরুর স্ত্রী তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাবা-মায়ের পরিবারের সাথে থাকেন বলে জানা গেছে। সুমী আকতারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।

সিএমপির চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলামের কাছে গতকাল সন্ধ্যায় নুরু হত্যায় নতুন করে দায়েরকৃত মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, এ ধরনের কোনো মামলা আমার থানায় পেন্ডিং নেই। এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

নুরুল আলম নুরু হত্যার পর হতে তার পরিবারের সাথে দলীয় তরফে যোগাযোগ রক্ষা করেন বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, নুরু ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহসী যোদ্ধা। সে জাতীয়তাবাদী হেল্প সেলের মাধ্যমে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের জন্য কাজ করত। রাজপথে তার ভূমিকা অপরিসীম। আওয়ামী মাস্তান এবং পুলিশ মিলে তাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে।