অনিশ্চিত রাজনীতির গন্তব্য কোথায়

রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার, নির্বাচন নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পরও সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না এমন সন্দেহের অবতারণা করছে কোনো কোনো মিডিয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। কিন্তু তারপরও ছোট গল্পের মতো ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ এমন সন্দেহ ও চাপা গুঞ্জন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

জুলাই আন্দোলনের পর অর্ধবছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার, নির্বাচন নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পরও সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না এমন সন্দেহের অবতারণা করছে কোনো কোনো মিডিয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। কিন্তু তারপরও ছোট গল্পের মতো ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ এমন সন্দেহ ও চাপা গুঞ্জন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। গ্রাম থেকে শহর অবধি চায়ের দোকান থেকে জনারণ্যে এমন পূর্বাভাস কৌশলে ছড়িয়ে দেয়ার একটা লক্ষণ স্পষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে। অন্য দিকে রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আইনজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যে কোনো সময়ের চেয়ে রাজনৈতিক সমালোচনা ও আগামী দিনের নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে নিজেদের মতামত খোলামেলা বলছেন টেলিভিশন টকশো থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অন্তত জুলাই আন্দোলনের পর বাক-স্বাধীনতায় কোনো ঘাটতি যে নেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে এবং এর অকপট স্বীকৃতি মিলেছে সব মহলে। কিন্তু তারপরও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য মতপার্থক্য কাটেনি, পাল্টা হুমকি ও আন্দোলন কর্মসূচি মেঘের গর্জনের মতোই শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে।

২৪ শে গণ-অভ্যুত্থানের পর এটি বিপ্লব নাকি নিছক রাজনৈতিক পরিবর্তন; সে নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। তবে জুলাই আন্দোলনে দেয়াল লিখনের অন্যতম একটি স্লোগান ছিল, ‘নাটক কম কর পিও’। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচন নিয়ে নাটক করার অভিযোগ এনেছে একটি বড় রাজনৈতিক দল। কিন্তু গণভোট দিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে গত কয়েক দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি যে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা বিরাজ করছিল তার একটা গণবিস্ফোরণ ঘটবে ‘হাঁ’ ভোটের মাধ্যমে। এজন্যই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পছন্দমতো নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে রেখেছেন।

নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ফ্যাসিস্টের রাজনৈতিক দলটি দেশে জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে প্রমাণ করছে, তাদের নেশাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। গতকাল মঙ্গলবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, দেশী-বিদেশী কোনো শক্তিই এ নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে, তবে সবাই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে বিএনপি ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, জামায়াতে ইসলামীও তাদের মতো করে প্রার্থী দিচ্ছে।

এরই মধ্যে ককটেলবাজদের দুই-একজন ধরা পড়তে শুরু করেছে। তাদের কাছে আমজনতার একটি প্রশ্ন কারা তাদের পাঠিয়েছে। ককটেলবাজরা বলতে শুরু করেছে নগদ অর্থ ও ককটেল তাদের হাতে তুলে দিয়ে বলা হচ্ছে মিছিল-সমাবেশ লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করার জন্য। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় বাসে আগুন দেয়ার পর দগ্ধ হয়ে মারা গেছে বাসটির ঘুমন্ত চালক। দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ছাত্রদল নেতাকর্মীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু প্রখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র তার কাছে নেই। বাহাত্তরের সংবিধান ধরে রাখার প্রাণান্তকর রাজনৈতিক প্রচেষ্টা এখনো বিদ্যমান। ভারত থেকে জোরালো আওয়াজ তুলে বাতাস ভারী করা হচ্ছে বাংলাদেশে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা হবে। ছাত্রলীগ নেতারা হুঙ্কার দিচ্ছেন পালাবার পথ পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের একজন সেরা বিতার্কিক গুরু টেলিভিশনের টকশোতে বলেছেন তার কাছে আওয়ামী লীগকে মনে হয় ক্যাঙ্গারু বাচ্চা নিয়ে ছুটছে। তিনি দেখতে চান এ ক্যাঙ্গারুর থলে থেকে আগামী দিনে বাঘ না হাতি বের হয়ে আসে। নির্বাচনকে ঘিরে ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন, গুলি করে মানুষ হত্যার মাঝেই সশস্ত্রবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বেড়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। একই সাথে আন্তর্জাতিক খবরে চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে দিল্লীতে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণের পর ইসলামাবাদে আদালতের বাইরে একই কায়দায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

কলঙ্কমুক্ত হতে নির্বাচন ও বাংলাদেশ দখল করে নেয়ার হুমকি : নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো অতীতের কলঙ্কমুক্ত হলে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। দলগুলো জুলাই সনদের আইনিভিত্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। নব্বইয়ে ঘোষিত তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নে একই ধরনের ব্যর্থতা এখনো কলঙ্ক হয়ে আছে; যার কারণে রাতের ভোট, বাক-স্বাধীনতাহীন ভয়ঙ্কর পরিবেশ, গুম, খুন, আয়নাঘর উদাহরণ সৃষ্টি করে আছে।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বা গোদি মিডিয়া হিসেবে পরিচিত আজতক ও ডিএনএ সরাসরি হুমকি দিয়ে বলছে ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশ দখল করে নিতে হবে। পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগরে এসেছে কিংবা পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ভারতের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আদতে বিহার ও আসাম নির্বাচনে মুসলিম বিরোধিতার উস্কানি সৃষ্টির জন্যে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে অন্তত তিনটি ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। কাশ্মিরে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যকলাপ রোধে ইসরাইলের সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি ছাড়াও দিন কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দশ বছরের সামরিক নিরাপত্তা চুক্তি করেছে ভারত। বাংলাদেশ এসব চুক্তি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেই কূটনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে দেখে এসেছে। অথচ ভারত তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণে চীনের সহযোগিতাকেও নিরাপত্তার হুমকি বলে মনে করে। ভারতের এসব হুমকিই বাংলাদেশকে নিরাপত্তার দিক থেকে চীন, তুরস্ক ও পাকিস্তানের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করতে কি বাধ্য করছে?

মরা বাপ পোলাকে ডাকে না : এটি পুরান ঢাকার একটি প্রবাদ। কালের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার প্রতীক। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে এসে শপথ ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন। সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সংবিধানের খসড়া নিয়ে নয়াদিল্লিতে ছুটে যাওয়ার পর ভারতীয় সংবিধানের মূলনীতিগুলো বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে আজকে যে শিশু সে-ও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের কোন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছিলেন। এসব প্রশ্ন ওঠে ইতিহাসের নির্মম জুলুম, ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার জন্য নতজানু হয়ে কাগুজে বাঘের মতো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারতের সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তৈরির কায়দায়। কিন্তু জুলাই আন্দোলন এসব রাজনৈতিক কল্পকাহিনীকে চুবিয়ে ছেড়েছে বঙ্গোপসাগরে। ফলে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দৃঢ়চিত্ত প্রকাশ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কণ্ঠে শুনে তা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না ভারত।

রাজনৈতিক গন্তব্য ঠিক হয়ে গেছে : আগে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তার রাজনৈতিক গন্তব্য নির্ধারণ করে নিয়েছে। তারপর রাজপথে নেমে এসেছে। সাথে নিয়ে এসেছে দীর্ঘতম কর্মসূচি হাতে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক নিরাপত্তাসহ সবকিছুতেই স্বনির্ভর হয়ে টিকে থাকার গল্প আছে এসব কর্মসূচিতে। এটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নিশ্চল অঙ্গীকার বলেই শতসহস্র ভারতীয় মনস্তাত্ত্বিক চাপে সে নির্ভার থাকতে পারছে। যেসব রাজনৈতিক দল মনে করছে ক্ষমতার মসনদে ফের বসতে পারলেই যা কিছু খুশি তা করতে পারবেন, বাহাত্তরের সংবিধান ধরে রাখতে পারবেন এবং তারই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে ভারতীয় দাসত্বের জয়গান শুরু করলেই জনতা ভয়ঙ্করভাবে ফের নিশ্চুপ নিস্তব্ধ হয়ে যাবে তারা দেয়ালে সেই লিখন একটু কষ্ট করে ফের পড়ে নিতে পারেন, ‘দেশটা কারো বাপের না’।