নিজ দলের প্রতীকেই ভোট

সংশোধিত আরপিও’র গেজেট

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

  • আদালতের ঘোষিত ফেরারি আসামি নির্বাচনে অযোগ্য
  • পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা পেল ইসি
  • ফিরেছে ‘না’ ভোট, বিনা ভোটে এমপি হওয়ার সুযোগ বন্ধ

জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে লড়লেও নিজ দলীয় প্রতীকেই ভোট করার সংশোধিত বিধান বহাল রেখেই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে সরকার। এর পাশাপাশি একজন সংসদ সদস্য প্রার্থী তার নির্বাচনী এলাকায় একজন ভোটারের জন্য সর্বোচ্চ ১০ টাকা খরচ করতে পারবেন। এর থেকে বেশি খরচ করলে ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া আদালতের ঘোষিত ফেরারি আসামি প্রার্থী হতে পারবেন না এবং বিনা ভোটে সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থাও ফিরেছে। আরপিওতে ইসিকে পুরো সংসদীয় এলাকা বা আসনের ফল বাতিলের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। গত সোমবার আইন মন্ত্রণালয় এ অধ্যাদেশের গেজেট জারি করে। এর আগে গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।

এই আরপিও সংশোধন বিশেষ করে ২০ অনুচ্ছেদের সংশোধিত অনুমোদন বাতিল করার জন্য ইসিসহ সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল বিএনপিসহ তার সমমনা ১২ দলীয় জোট। পাশাপাশি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ সমমনা আটটি ইসলামী সংগঠন ২০ অনুচ্ছেদের সংশোধিত বিধান বহাল রাখার দাবি জানিয়ে ইসিতে দফায় দফায় স্মারকলিপির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করছিল।

আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশে এবারের নির্বাচনে বেশ কিছু নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো- আদালত ঘোষিত ফেরারি আসামি ভোট করতে পারবেন না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত হয়েছে। একক প্রার্থীর আসনে ব্যালটে ‘না’ ভোট ফিরছে। সমান ভোট পেলে হবে পুনঃভোট, রাজনৈতিক দলগুলো জোট বেঁধে নির্বাচন করলেও নিজ দলের মার্কায় ভোট, জামানত ৫০ হাজার টাকা, দল আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা, আইটি সাপোর্টে পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি, অনিয়মে পুরো আসনের ভোট বাতিল, এআই এর অপব্যবহার করলে নির্বাচনী অপরাধ এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে (ভোটে অযোগ্য এমন) নির্বাচিত হওয়ার পরও ব্যবস্থা নিতে পারবে ইসি।

আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী ও কোস্ট গার্ড যুক্ত করা হয়েছে ২ নম্বর অনুচ্ছেদে। আর অনুচ্ছেদ ১২তে কোনো আদালত কর্তৃক ফেরারি বা পলাতক আসামি হিসেবে ঘোষিত হলে তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন। সেক্ষেত্রে পলাতক আসামি প্রার্থী হতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা অন্য কোনো পদে অধিষ্ঠিত থাকলে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।

কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদকে ‘লাভজনক’ পদের সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদে থেকে কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না। হলফনামায় দেশে-বিদেশে আয়ের উৎস এবং সবশেষ বছরের রিটার্ন জমা দিতে হবে। প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য সংক্রান্ত হলফনামায় অসত্য তথ্যের প্রমাণ পেলে ভোটের পরও ইসির ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা যুক্ত করা হয়েছে।

আর অনুচ্ছেদ-১৯-এ ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যদি একজন থাকে, তাহলে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের বিধান থাকবে। তবে দ্বিতীয়বার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘না’ ভোট থাকবে না। তবে অনুচ্ছেদ-২০-এ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া অনুচ্ছেদ-২১-এ নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার হতে হবে। আর অনুচ্ছেদ ২৬-এ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ইভিএমে ভোট দেয়ার বিধান বিলুপ্ত হলো। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত বিধানগুলো বিলোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া অনুচ্ছেদ-২৭-এ পোস্টাল ভোটিংয়ের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী ও দেশের ভেতরে আটক ভোটারদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট পদ্ধতির বিধান এবার যুক্ত হলো।

সংশোধিত আরপিওতে পরিমার্জন করে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের তালিকায় গণমাধ্যমকর্মীদের থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ভোট গণনার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিত থাকার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সমভোট পেলে লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট হবে। আগে সমভোট প্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে লটারি করে একজনকে নির্বাচিত করার বিধান ছিল। এ অনুচ্ছেদে বেশ কিছু নতুন সংযোজন এসেছে। প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় ভোটার প্রতি ১০ টাকা সর্বোচ্চ নির্ধারণ করা হয়েছে।

নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করে পরিমার্জন করা হয়েছে। অনুদান হিসেবে পাওয়া অর্থের তালিকা বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট করে ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শকের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।

আর অনুচ্ছেদ-৭৩-এ মিথ্যা তথ্য, অপতথ্য, গুজব ও এআই অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও দলের বিষয়ে অপরাধের বিধানটি যুক্ত করা হয়েছে। দল নিবন্ধন ও আর্থিক অনুদানের বিষয় এবং নিবন্ধন স্থগিত হলে প্রতীক স্থগিত করার বিধান রয়েছে অনুচ্ছেদ ৯০-এ।

আরপিও’র অনুচ্ছেদ ৯১ তে অনিয়মের জন্য কেন্দ্রের ভোট বাতিলের পাশাপাশি প্রয়োজন হলে পুরো নির্বাচনী এলাকার ফল বাতিলের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ইসিকে। আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দলের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান রয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিধান রয়েছে। এ অনুচ্ছেদে হলফনামার অসত্য তথ্য দেয়ার বিষয়ে যাচাই করে দেখা ও ভোটের পরও ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ইসিকে।