বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৭৮ সালের এই দিনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় দেশের বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির। তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি এমন একটি সময়ে ৪৭ বছরে পা রাখছে, যখন দলটি স্বৈরাচার আমলের দীর্ঘ জেল-জুলুম পেছনে ফেলে গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে বাধাহীন পথ অতিক্রম করছে। লক্ষ্য এখন তাদের নির্বাচন। স্বপ্ন আবারো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার। দলটি পুরনো বৃত্ত ভেঙে রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়। নেতারা বলছেন, গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং পরিবর্তনের এই পথটিও অনেক চ্যালেঞ্জের, কারণ ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র অব্যাহত। আগামী দিনগুলোতে দলটির নেতারা তাই জোর দিচ্ছেন রাজনৈতিক ঐক্যের উপর।
প্রতিষ্ঠার পটভূমি ও পথপরিক্রমা : শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠার আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে তিনি বিএনপি গঠন করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন প্রথম মহাসচিব।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই ছিল জিয়াউর রহমানের মূলমন্ত্র। এর ফলে দলটি প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। জিয়াউর রহমান স্বল্প সময়ের অক্লান্ত কর্মের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েন পুরো বাংলাদেশে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে ইসলামী মূল্যবোধের মিশ্রণ তার দলকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। তার ঘোষিত ১৯ দফাকে দল ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এক ‘রাজনৈতিক দর্শন’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণের পর স্বৈরাচার এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে উত্থান ঘটে বেগম খালেদা জিয়ার।
১৯৯০ সালে গণতন্ত্রায়নের পর ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিনটিতেই বিএনপি জয়লাভ করে। তবে এক-এগারো সরকারের দুই বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলটি পরাজিত হয়। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা। চরম বৈরী পরিবেশ সত্ত্বেও ২০১৮ সালে একাদশ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পিত কারচুপির ওই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র সাতটি আসন পায়। নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে অভিযোগ করে দলটি ওই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। ওই নির্বাচনের এক বছর আগে কারাবন্দী হন বেগম খালেদা জিয়া। তখন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন তারেক রহমান।
চার দশক আগে রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয় বিএনপির। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় দলটি যেমন তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে, তেমনি বহুবার সীমাহীন প্রতিকূল পরিস্থিতিও মোকাবেলা করেছে। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকারের সময়ে দলটির ওপর যে মামলা, হামলা, জেল, জুলুম শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে সেই দুঃসহ পর্ব শেষ হয়েছে।
দলটির তথ্য অনুযায়ী, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে লক্ষাধিক রাজনৈতিক মামলা দিয়েছিল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আসামি করা হয়েছিল ৩৫ লাখেরও বেশি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর বাইরে গুম হয়েছেন পাঁচ শতাধিক।
টার্গেট আগামী নির্বাচন : বিএনপির লক্ষ্য এখন আগামী নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটিকে ঘিরে দলটি নির্বাচনী কলা-কৌশল সাজাতে শুরু করেছে। আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে দলটি আসন্ন এই নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চায়। জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কারা হতে পারেন, সেটি নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কাজ চলছে। এর অংশ হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে একাধিক জরিপও করা হয়েছে। কাকে কোথায় প্রার্থী করলে জিতে আসতে পারে, একই সাথে পজিটিভ ইমেজ আছে- এগুলো বিবেচনা করে প্রার্থী চূড়ান্ত করার চিন্তা-ভাবনা করছে বিএনপি। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার আগেই প্রাথমিক বাছাই শেষ করবে দলটি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সিডিউল ঘোষণার পরপরই বিএনপি তাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবে। অবশ্য নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠ পর্যায়ে আছেন। যারা মনোনয়ন পেতে পারেন অথবা মনোনয়ন প্রত্যাশী, তারা নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। দল ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফাকেন্দ্রিক প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বিএনপি মনে করছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন অত্যন্ত কঠিন ও চ্যালেঞ্জের হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় বিভিন্ন ফোরাম এবং সাংগঠনিক কর্মসূচিতে একাধিকবার এ কথা বলেছেন। নেতাকর্মীদেরও সেভাবে সতর্ক থাকতে বলেছেন। একই সাথে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের পাশে থেকে তাদের মন জয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখতে ৫ আগস্টের পরে অপকর্মে জড়িত এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দল ও অঙ্গ সংগঠনের চার হাজারের অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ শাস্তিমূূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী দিনে মনোনয়ন প্রক্রিয়ায়ও সেটা বজায় রাখা হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। বিতর্কিত কাউকেই তিনি প্রার্থী করতে চান না। রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে তিনি গুণগত পরিবর্তন চান বলে দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন।
বিএনপির কমিটমেন্ট রয়েছে, আগামীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে জুলাই সনদের পাশাপাশি তারা তাদের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করে জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাবে। একই সাথে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে জাতীয় সরকারো গঠন করবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা দাবি-দাওয়া এবং কিছুটা অস্থিরতা থাকলেও তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছে দলটি। নেতাদের বিশ^াস, নির্বাচন হলে সব সঙ্কটের দ্রুত সমাধান হবে।
গণতন্ত্রকামী দলগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্ষণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দীর্ঘ দেড় দশক পরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ছাত্র-জনতার নিঃস্বার্থ আত্মদানের মধ্য দিয়ে গত বছর জুলাই-আগস্টে স্বৈরাচারী দানব আওয়ামী সরকারের পতন হয়েছে। এখন বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে গণতন্ত্রকামী দলগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, এত দিন গুম-খুনের আতঙ্ক মানুষের নিত্য সঙ্গী ছিল। এখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন সুদৃঢ় করতে পারলেই নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। দুঃশাসনের যে কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল সেটি সমূলে উপড়ে ফেলে একটি পরমতসহিষ্ণু, শান্তিময় এবং মানবিক সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই জাতীয়তাবাদী শক্তির মূল লক্ষ্য।
কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ বেলা ১১টায় দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর শেরেবাংলা নগরস্থ মাজারে মহাসচিবসহ দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং আগামীকাল বেলা ২টায় দলের নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
দিবসটি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে ভোরে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি সামনে রেখে পোস্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।