বাংলাদেশের একটি পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার ঝুমগাঁও এখন ভুতুড়ে আস্তানায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রিয় সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত আর আর্থিক অসচ্ছলতায় যেন প্রাণ হারিয়েছে গ্রামটি। একসময়ে এই গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা বেড়াতে আসতেন; কিন্তু এখন আর তেমন কেউ আসেন না এ গ্রামে বেড়াতে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের ভারত সীমান্তে অবস্থিত গ্রামটি সমতল ভূমি থেকে ১০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। এখানে প্রায় ৫০টি আদিবাসী পরিবারের বসবাস। সীমান্তঘেঁষা এই পাহাড়ি আদিবাসী গ্রামটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকেই নয়, সামাজিক দিক থেকেও আকর্ষণীয় ছিল। ঝিরি নদীর স্বচ্ছ জলধারা, সবুজ টিলার সারি, ফুলে ভরা পথঘাট ও আন্তঃদেশীয় সীমানা পিলারের সংলগ্ন সবুজ ঘেরা সমারোহ- এসব মিলিয়ে ঝুমগাঁও ছিল প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ঝুমগাঁও গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ১৫০ ফুট উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে এখনো চোখে পড়ে ঝুমগাঁওয়ের বর্ণিল সৌন্দর্য। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত গ্রামটির বুক চিড়ে মেঠোপথের দু’পাশে সাজানো রঙ-বেরঙের পাতাবাহারগাছের সারি, লাল, সবুজ, হলুদ ও গোলাপি পাতার সমারোহ একসময় ছিল প্রকৃতির এক বর্ণিল চিত্রকর্ম। আরো ছিল আদিবাসীদের ঘরের আঙিনা ও বারান্দায় সাজানো ফুলের বাগান, যা এই গ্রামকে করে তুলেছিল মনোমুগ্ধকর। এখানে ছিল নানান জাতের ফুল, পাতাবাহারগাছ, সুগন্ধি লেবু ও রসালো কাঁঠালের বাগান; কিন্তু এই সৌন্দর্য এখন আর চোখে পড়ে না।
সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামটির উত্তর-পশ্চিম দিকে ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার। এই পিলারের আশপাশে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাটির ঘর, যা এখনো তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে টিকে আছে। সীমানা পিলারের খুব কাছ থেকেই দেখা যায় অক্ষত, অক্ষুণœ ‘ভার্জিন মেঘালয়’, সবুজ পাহাড় আর মেঘের অপার সৌন্দর্যে ভরপুর এক অনিন্দ্য প্রাকৃতিক দৃশ্য। ঝুমগাঁও গ্রামে রয়েছে একটি ‘ঝিরি’ বা পাহাড়ি ছোট্ট ঝরনা। শুষ্ক মৌসুমে যেখানে পানি থাকে অল্প, বর্ষায় তা রূপ নেয় এক স্বচ্ছ সবুজ জলধারায়। এই পানি নেমে আসে মেঘালয়ের পাহাড়ি বৃষ্টির পানি থেকে। গ্রামের লোকজন এই ঝিরির পানিতেই গোসল করে। ঝুমগাঁও গ্রামের এক কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টর বাঁশতলা। আর এই বাঁশতলার মূল আকর্ষণ ছিল ঝুমগাঁওকে ঘিরে। দর্শনার্থীরা এখন বাঁশতলায় আসা-যাওয়া করলেও ঝুমগাঁও পড়ে থাকে সুনসান নীরবতায়।
স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী এম এ মোতালিব ভূঁইয়া বলেন, ঝুমগাঁও শুধু একটি গ্রাম নয়- এটি একটি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের নাম। সীমান্তঘেঁষা এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটি আমাদের শেখাতো কিভাবে পরিচ্ছন্নতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতি একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু অবহেলাজর্জরিত, উন্নয়নবঞ্চিত এই গ্রামটিতে এখন আর আগের দৃশ্য চোখে পড়ে না। গ্রামটি হারিয়েছে তার প্রাণ। গ্রামটিতে এখন আগের মতো প্রকৃতিপ্রেমীদের আনাগোনা নেই। স্থানীয় প্রশাসন একটুখানি উদ্যোগ নিলে ঝুমগাঁও ফের ফিরে পাবে তার প্রাণ। আমরা পাবো আমাদের পর্যটনস্পট।
এ বিষয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অরূপ রতন সিংহ জানান, ঝুমগাঁও গ্রামের প্রাণ ফেরাতে শিগগিরই কিছু উদ্যোগ নেয়া হবে। আশা করি দর্শনার্থীরা আবারো আগের মতো ভিড় জমাবে এই ঝুমগাঁওয়ে বেড়াতে এসে।



