আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভালো ফলাফলের প্রত্যাশা করছে ইসলামী দলগুলো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনসাধারণের মধ্যে ইসলামী দলগুলোর প্রতি আস্থা ও বিশ^াস বেড়েছে বলে মনে করে দলগুলোর নেতারা। এতে আশায় বুক বেঁধেছে ইসলামী দলগুলো। তবে এককভাবে কোনো দলের পক্ষেই ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়-এমনটাও মনে করেন তারা। এজন্য দলগুলোর ঐক্য কিভাবে আরো সুসংহত করা যায় সেদিকে মনোনিবেশ করছে দলগুলো। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষের সাম্প্রতিক ঐক্যবিরোধী ভূমিকাকে পাত্তা না দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে নেতাদের।
বিগত হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে ইসলামী দলগুলো। গ্রেফতার, রিমান্ড, গুমসহ সব ধরনের হয়ারনির শিকার হয়েছে দলগুলোর নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলে দেশে ইসলামী দলগুলোর জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য প্রত্যাশাও বেড়েছে। সাধারণ জনগণও হাসিনা সরকারের সময়ে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ চরম হয়রানির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া বিগত বিএনপি আমলেও দেশে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হয়েছে জনগণ। ৫ আগস্টের পরও তাদের একশ্রেণীর নেতাকর্মী মাঠপর্যায়ে ব্যাপক চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়লে জনমনে তাদের নিয়েও বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য মানুষ বিকল্প হিসেবে ইসলামী দলগুলোর দিকে ঝুঁকেছে। এছাড়া মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে শুরু থেকেই মানুষ যথেষ্ট ধার্মিক। সেজন্য ইসলামী দলগুলোর ভোটার সংখ্যাও কম নয়। এ অবস্থায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর মুফতি রেজাউল করিম আগামী নির্বাচনে ইসলামী ভোটগুলোর একটি বাক্সের কথা বলেছেন।
তবে দেশে যেসব ইসলামী দল রয়েছে তারা বিগত সময়ে কখনোই এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এককভাবে কোনো ইসলামী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সব ইসলামী দল এক হয়ে একটি জোট গঠন করতে পারলে সেটি ভালো ফল বয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন দলগুলোর নেতারা। এজন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) ইতোমধ্যে পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎভাবে গত কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছে। সব দলের প্রতিনিধি নিয়ে একটি লিয়াজোঁ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে যৌথভাবে সমাবেশ করবে ৮ দল। সেজন্য সেখানকার নেতাদের নিয়েও লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের কাজ চলছে। যারা পরবর্তী আন্দোলন-নির্বাচনে সমন্বয়ের কাজ করবেন। আন্দোলনরত ৮টি দল বর্তমানে তাদের নির্বাচনী জোট হিসেবে দাবি না করলেও ধীরে ধীরে সেদিকেই আগাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামীতে এ জোটে আরো দল বাড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দু’টি গ্রুপ বিএনপির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিএনপি ২৩৭টি আসনে তাদের দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলেও বাকি আসনগুলোতে তাদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেনি। এর মধ্যে জমিয়তের দুটি গ্রুপের শীর্ষ নেতারা নির্বাচন করবেন এমন কয়েকটি আসনও খালি রয়েছে। তাদের নেতারা ইতোমধ্যে ইসলামী ৮ দলের সাথে না থাকার ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির সাথে থাকারও অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা রয়েছে তাদের। এ ছাড়া সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন নতুন ইসলামী সংগঠনের নামে রাজধানীতে কয়েকটি সভা-সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে সুদুর পটিয়া থেকে হেফাজতে ইসলামের আমিরকে হেলিকপ্টারে করে এনে বক্তৃতা দেয়ানো হয়েছে। যেসব বক্তব্য নিয়ে ইসলামী অঙ্গনেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এসব সভা-সেমিনার ইসলামী দলগুলোর ঐক্য ভাঙতে পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন দলগুলোর নেতারা। এ ছাড়া এসব সভা-সেমিনারে বাইরে থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে বলেও কানাঘুষা রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে হেফাজত আমিরের উপস্থিতিতেই বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, বর্তমানে ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে এর বিরোধী অবস্থান নিলে শত শত বছর ধরে এর মাসুল গুনতে হতে পারে। এজন্য বৃহত্তর স্বার্থে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করার আজন্ম যে স্বপ্ন সেই স্বপ্নকে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে বর্তমান অবস্থাকে অনুকূল পরিবেশ বিবেচনা করে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় করণীয় ঠিক করতে গতকাল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি তাদের কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিং করেছে। ওই সভা দু’টি থেকেও নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের বিকল্প নেই বলে শীর্ষ নেতারা মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেন, দেশবাসী মনে করে জুলাই বিপ্লবের পর নতুন বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার এবারই উপযুক্ত সময়। এজন্য দেশবাসী ইসলামী দলগুলোর কার্যকর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যেক আসনে ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে একজন প্রার্থী দেখতে চায় ভোটাররা।
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভায় নেতারা মতামত দেন, একটি নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে হলে জনগণের অধিকার, ন্যায়ের শাসন এবং ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এজন্য ইসলামপ্রিয় জনতা, সব রাজনৈতিক শক্তি ও সচেতন জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সম্ভব দেশে একটি ইনসাফভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
গতকাল সিলেটে এক সভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেছেন, জুলাই বিপ্লব হয়েছে বৈষম্য বিলোপ করে ঐক্য ও ইনসাফ কায়েমের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দেশ ও জাতির স্বার্থ উপেক্ষা করে বিভক্তি-বিভাজনের পথে হাঁটছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইনসাফ কায়েম করতে চায়। এরই প্রক্রিয়া হিসেবে ইতোমধ্যে ৮ দলের সমন্বয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা মনে করছেন মানুষ দেশের শাসন কাঠামোতে একটি পরিবর্তন চাচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে সংস্কার কার্যক্রম তার বাস্তবায়ন দেখতে চায় তারা। এজন্য আগামী দিনে যারা সংস্কারের পক্ষে থাকবে এবং প্রকৃতভাবেই সংস্কারের মনোভাব রয়েছে এমন দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় জনগণ। এছাড়া বিগত দিনের চাঁদাবাজি-দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচারের সমাজ পরিবর্তনে শাসনক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদেরও পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।


