কাঁচা পাট রফতানিতে শর্তারোপে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি

শাহ আলম নূর
Printed Edition

দেশের ঐতিহ্যবাহী ও রফতানিমুখী খাত হিসেবে পরিচিত পাট শিল্প আবারো আলোচনার কেন্দ্রে। একদিকে কাঁচা পাটের বাজারে সরবরাহ সঙ্কট ও দামের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, অন্য দিকে পাটকলগুলোতে কাঁচামালের অভাব। এই প্রেক্ষাপটে সরকার স্থানীয় পাটকল রক্ষায় কাঁচা পাট রফতানির ওপর শর্ত আরোপ করেছে। এখন থেকে কাঁচা পাট রফতানি কেবল অনুমোদনসাপেক্ষে করা যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মজুদের কারণে কাঁচা পাটের বাজারে রেকর্ড দামের সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকরা এবার প্রতি মণ পাট ৩,৬০০ থেকে ৪,২০০ টাকায় বিক্রি করেছেন, যা গত বছরের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ বেশি। বর্তমানে মাঝারি মানের পাটের দাম প্রতি মণ ৩,৮০০-৪,০০০ টাকা এবং উৎকৃষ্ট মানের ফাইবারের দাম ৪,০০০-৪,২০০ টাকা। পাটকল মালিকদের অভিযোগ, সেপ্টেম্বরের শুরুতেই বেশির ভাগ কৃষক তাদের পাট বিক্রি করে ফেলেছেন। ফলে মিলগুলোকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ৮ সেপ্টেম্বর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, এখন থেকে কাঁচা পাট রফতানির আগে রফতানিকারকদের অনুমতি নিতে হবে। মূলত মধ্যাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে উৎপাদিত পাটকে কেন্দ্র করে এ নিয়ম কার্যকর করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, রফতানিকারকদের আবেদন করতে হবে। অনুমোদিত পরিমাণ পাটই কেবল রফতানি করা যাবে।

সরকার চলতি মৌসুমে ৭.৫ মিলিয়ন বেল পাট উৎপাদনের প্রত্যাশা করছে, যা আগের বছরের ৮.৯ মিলিয়ন বেলের চেয়ে কম। তবে কারখানা মালিকরা বলছেন, উৎপাদন ৬.৫ মিলিয়ন বেলের বেশি হবে না। অন্য দিকে দেশের বার্ষিক প্রয়োজন প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন বেল। এর মধ্যে ৫.৫ মিলিয়ন বেল কল ও অন্যান্য খাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) চেয়ারম্যান তপন প্রামাণিক বলেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে যখন ঘাটতি থাকে তখন রফতানি করা একধরনের বিলাসিতা। এটি জাতীয় স্বার্থে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। তিনি আরো বলেন, ‘অনেকে বলছেন, রফতানি বন্ধ হলে দামের পতন ঘটবে। এটি সঠিক নয়। আসলে মজুদদাররা সঙ্কট ও রফতানির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।”

বস্ত্র ও পাটসচিব মো: আব্দুর রউফ বলেন, সরকারের লক্ষ্য হলো স্থানীয় বাজারে কাঁচা পাটের সরবরাহ বাড়ানো এবং পাটের বস্তা উৎপাদন ত্বরান্বিত করা। তিনি বলেন, ‘আমরা বাধ্যতামূলক প্যাকেজিং আইন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়াতে চাই। চালকল মালিকরা ইতঃমধ্যে চালের প্যাকেজিংয়ে পাটের বস্তা ব্যবহার করতে সম্মত হয়েছেন। এ জন্য প্রায় ৮০০ কোটি বস্তার প্রয়োজন হবে।’

বাংলাদেশের কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি গত এক দশকে ওঠানামার মধ্য দিয়ে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি সর্বোচ্চ ১.১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। এরপর থেকে তা ক্রমেই কমতে থাকে এবং গত অর্থবছরে রফতানি নেমে আসে ৮২০ মিলিয়ন ডলারে, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

তবে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে রফতানির পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এ সময় মোট রফতানির মধ্যে কাঁচা পাটের অংশ ছিল ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ বৈদেশিক বাজারে এখনো কাঁচা পাটের চাহিদা রয়েছে, তবে স্থানীয় শিল্পের চাহিদার সাথে ভারসাম্য বজায় রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাট বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। এ খাত থেকে সরকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, আবার গ্রামীণ অর্থনীতিও এর সাথে জড়িত। রফতানি সীমিত করার সিদ্ধান্ত স্বল্পমেয়াদে বৈদেশিক আয়ে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সরকার বলছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করাই এখন মূল লক্ষ্য। কারণ স্থানীয় পাটকল ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকলে কর্মসংস্থান ও শিল্পখাত রক্ষা পাবে।

অন্য দিকে কৃষকরা এ বছর ভালো দাম পেয়েছেন। অনেকের মতে, রফতানিতে শর্ত আরোপ করলেও কৃষকের প্রাপ্ত দামে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ জরুরি।

সরকারি সিদ্ধান্তকে অনেকেই স্বাগত জানালেও সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, যদি উৎপাদন কম হয় তবে স্থানীয় শিল্পের চাহিদা মেটানো কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হলে দীর্ঘমেয়াদে রফতানি খাতে ক্ষতি হতে পারে। তৃতীয়ত, মজুদদার ও সিন্ডিকেটদের দৌরাত্ম্য দমন করা না গেলে বাজার অস্থিরই থেকে যাবে।

এ দিকে বাংলাদেশের পাট শিল্প বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ, অন্য দিকে স্থানীয় শিল্পের কাঁচামালের সঙ্কট। সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত মূলত দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতেই নেয়া হয়েছে। তবে এর সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনা, সঠিক নজরদারি এবং কৃষক ও শিল্প মালিক উভয়ের স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁচা পাট রফতানিতে শর্ত আরোপ করা একটি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হলেও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধানের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধি, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি অপরিহার্য। তবেই পাট শিল্প আবারো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সোনালি অতীতের অবস্থান ফিরে পেতে পারে।