দুই দফায় অন্তর্বর্তী কমিটির মেয়াদ শেষ

ভোট ছাড়াই মিল্ক ভিটায় কমিটি দিতে তোড়জোড়

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন হবে -আইনজীবী

উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচিত কমিটি ছাড়া অনির্বাচিত কমিটিকে বারবার নিয়োগ দেয়া যাবে না বা বর্ধিত করা যাবে না।

কাওসার আজম
Printed Edition

মিল্ক ভিটার চার মাসের অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ বাড়িয়ে ৮ মাস করা হয়। দ্বিতীয় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে গত ২ আগস্ট। তবে এর আগে থেকেই নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটির মতোই অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ আরো তিন বছর বাড়ানোর ‘আবদার’ করেছেন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি জাহিরুল আলিম। ১২ সদস্যের প্রস্তাবিত কমিটির পক্ষে সমবায় অধিদফতরে সুপারিশ করেছেন মিল্ক ভিটার এমডি জাহিদুল ইসলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমবায় অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত নিবন্ধক ও মহাপরিচালক ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কাছে এই কমিটির অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছেন বলে জানা যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত সচিব মুনিমা হাফিজ। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের এই অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বাজেট) বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে কেন ভাই জানতে চান আপনারা। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’

জানা যায়, উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের (সিভিল পিটিশন নম্বর হলো ১৬৪২ /২০১৫) নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচিত কমিটি ছাড়া অনির্বাচিত কমিটিকে বারবার নিয়োগ দেয়া যাবে না বা বর্ধিত করা যাবে না। কিন্তু এই নির্দেশনা না মেনে সমবায়ীদের ভোট ছাড়াই তিন বছরের জন্য অনির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের প্রস্তাবে সায় দিয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছে সমবায় বিভাগ।

জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিনা ভোটেই সমবায়ীদের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটায় ব্যবস্থাপনা কমিটি দেয়া হয়। বিগত আওয়ামী আমলের শেষে প্রায় ৯ বছর মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার চাচা শেখ নাদির হোসেন লিপু, যার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটিতে নানা দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার আসার কয়েক মাস পর গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ইউনিয়ন বা মিল্ক ভিটা) ছয় সদস্যের একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি (অ্যাডহক) গঠন করে দেয় সরকার। মিল্ক ভিটা ব্যবস্থাপনা নির্বাহ ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সমবায় আইন,২০০১ (সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩) এর ১৮(৫) ও ১৯(৩) ধারার বিধান মোতাবেক সমবায় অধিদফতর থেকে এক আদেশে নৌ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার জাহিরুল আলিমকে সভাপতি করে এই অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর পাঁচজন হলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের একজন উপসচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব (প্রতিষ্ঠান-২), মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, সমবায় অধিদফতরের যুগ্ম নিবন্ধক মোহাম্মদ মনি

সমবায় সমিতির এই আদেশে বলা হয়, কমিটির মেয়াদ পত্র জারির তারিখ থেকে ১২০ দিন বলবৎ থাকবে। কমিটিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩) এর ১৮(৬) এর ধারার নির্দেশনা অনুযায়ী মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করার জন্য অনুরোধ করা হলো। সমবায় অধিদফতরের তখনকার নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মো: শরিফুল ইসলাম এতে স্বাক্ষর করেন। চার মাসের মধ্যে মিল্ক ভিটার নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা থাকলেও অ্যাডহক কমিটি তা করতে ব্যর্থ হয়। গত ৩০ এপ্রিল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ থেকে এসআরও জারি করে দ্বিতীয় মেয়াদে আরো চার মাস সময় বাড়ানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিদ্যমান অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ হতে আরো ১২০ দিন অর্থাৎ ৫ এপ্রিল থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হলো।

পূর্ণাঙ্গ কমিটির মেয়াদ দুই দফা শেষ হওয়ার পর মিল্ক ভিটায় নতুন করে তিন বছরের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্য সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসা জাহিরুল আলিম। গত ২৭ জুলাই মিল্ক ভিটার প্যাডে কমিটির মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদনে উল্লেখ করেন, অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি গত ১৫ মে অনুষ্ঠিত কমিটির চতুর্থ সভায় বিগত ২৬ জুলাই সমিতির বিশেষ সাধারণ সভা ও নির্বাচন-২০২৫ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী কার্যক্রমও শুরু করে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন ও নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর হাইকোর্টে রিট পিটিশন (নং-৯৭৯৪/২০২৫) দায়ের হয়। আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় সমিতির মাধ্যমে নির্বাচন ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। একইসাথে ৪৪টি রিট আবেদনকারী সমিতিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে মিল্ক ইউনিয়নের লিভ টু আপিলের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক ফারাহ মাহবুব গত ২৩ জুন হাইকোর্টের রিট পিটিশনের আদেশকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেন এবং একই দিন চূড়ান্ত শুনানির সময় বেঁধে দেন। তবে, গত ৪ আগস্ট এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানান মিল্ক ভিটা সংশ্লিষ্টরা।

ভোট ছাড়াই ৩ বছরের অ্যাডহক কমিটির আবদার

মিল্ক ভিটার অন্তর্বর্তী কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসা জাহিরুল আলিম সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো আবেদনে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে তিন বছরের জন্য অনুমোদনের জন্য অনুরোধ জানান। এই তালিকায় একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে নকল দুধ তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে; কেউ এতে গ্রেফতারও হয়েছিলেন।

জাহিরুল আলিম আবেদনে উল্লেখ করেন, মিল্ক ইউনিয়ন দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির উপর নির্ভরশীল। দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির উপর শতভাগ নির্ভরশীল না হয়ে মিল্ক ইউনিয়নের নিজস্ব দুগ্ধ উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য দক্ষ নেতৃত্বে ইউনিয়নকে একটি মিল্ক ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি, ভারসাম্যপূর্ণ ও টেকসই পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। তাই নির্বাচন সংক্রান্ত আইনি সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারবাহিকতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করেন তিনি।

এ দিকে মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুল ইসলাম তিন বছরের জন্য জাহিরুল আলিমকে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে পুনঃনিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করে সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক বরাবর দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করেন, মিল্ক ভিটার চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যেতে পারে বলে মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ মনে করে।

জাহিদুল ইসলাম এ ধরনের সুপারিশ করতে পারেন কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে গত বুধবার তেজগাঁওয়ে মিল্ক ভিটার অফিসে গিয়ে জানা যায়, তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। গতকাল শনিবার বিকেলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

ওদিকে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও জাহিরুল আলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি এখনো অফিস করেন। গত বুধবার দুপুরে তেজগাঁওয়ে মিল্ক ভিটার অফিসে চেয়ারম্যানের রুমে তাকে পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, অফিস করেন না। এমনিতেই মাঝে মধ্যে আসেন।

তার নেতৃত্বে ১২ সদস্যের কমিটির প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। শুধু বলেন, কর্তৃপক্ষ চাইলে দিতে পারে (নতুন কমিটির অনুমোদন), না-ও পারে- এটা তাদের বিষয়।

গত ৩১ জুলাই সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে সচিব বরাবর মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশে বলা হয়, কমিটির বর্তমান সভাপতি (মেয়াদোত্তীর্ণ) জাহিরুল আলিম ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে পুনঃনিয়োগের আবেদন করেছেন। চিঠিতে বলা হয়, ‘...সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ (সংশোধিত) ২০০২ ও ২০১৩)এর ১৮(৭) ধারার অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির ধারা (৬) এ বর্ণিত মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করিতে ব্যর্থ হইলে মেয়াদ পূর্তির সাথে সাথেই ওই কমিটি বিলুপ্ত হইবে এবং নিবন্ধক উপধারা (৫) ও (৬) এ উল্লিখিত শর্ত ও সময়ের জন্য আবার একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করিবেন : তবে, শর্ত থাকে যে, বিলুপ্তকৃত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা পরবর্তী কোনো অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’

এ অবস্থায় সমিতির (মিল্ক ভিটা) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রস্তাবনা এবং সমিতির সভাপতির প্রস্তাবনা অনুযায়ী সমবায় সমিতি আইন ২০০১ (সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩) এর ৪ ধারা মোতাবেক সরকারের উপর অর্পিত ক্ষমতাবলে একই আইনের ১৮(৫) ও ১৮(৭) ধারা শর্ত হতে অব্যাহতি প্রদান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে অথবা সমবায় সমিতি আইন,২০০১ (সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩) এর ১৮(৭) ধারা মোতাবেক নতুন অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো।

‘এ দিকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব এবং সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক বরাবর উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো: গোলাম হাসনায়েন। পাবনার বেড়ার হারিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি মো: শাহীন রেজা সরদারের পক্ষে তিনি এই নোটিশ দেন। এতে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন ১৬৪২/২০১৫-এ নির্দেশনা আছে যে, নির্বাচিত কমিটি ছাড়া অনির্বাচিত কমিটিকে বারবার নিয়োগ দেয়া যাবে না বা বর্ধিত করা যাবে না

তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, সমবায় আইনের ২২ (৯) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে অন্তর্বর্তী কমিটি যদি ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে ওই কমিটির পরিবর্তে নতুন অন্তর্বর্তী কমিটি দিতে হবে। আইনের সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সরকার কমিটিকে আবার নিয়োগ দিতে ইচ্ছুক হওয়া আদালত অবমাননার শামিল এবং বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করেন তিনি।