বাংলাদেশে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বেড়ে প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ২ শতাংশে আসতে পারে। সংস্থাটি বলছে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বিডিপি ৫ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক পুরোপুরি আরোপ হলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বড় ধরনের অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকবে। কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিওং মনে করেন- বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে, যা গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
রাজধানীর আগারগাঁওস্থ এডিবির আঞ্চলিক কার্যালয়ে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। আউটলুকটি তুলে ধরেন এডিবির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট চন্দন সাপকোটা। বক্তব্য রাখেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিওং। সংস্থাটি জানায়, প্রবৃদ্ধির এ হিসাব ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের আগে করা হয়েছে। তবে এর আগে তারা প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৪ দশমিক ৩ শতাংশ দিয়েছিল।
জিওং বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যেমন ধীরগতির অর্থনীতি, ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, সীমিত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ, কম বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ, ব্যাংকগুলোতে ক্রমবর্ধমান অ-কার্যকর ঋণ ও অপর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তা সত্ত্বেও এটি আশ্বস্ত করার মতো যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে একটি প্রধান লক্ষ্য করেছে।
এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি গত অর্থবছর ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হতে পারে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, খুচরা বাজারের প্রতিযোগিতা কমে যাওয়া, বাজার সম্পর্কে যথাযথ তথ্য না থাকা, সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তবে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এডিবি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে তা কমে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসতে পারে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাণিজ্য ঘাটতি কমছে এবং রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাড়ছে।
এডিবি বলছে, বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের রফতানিতে গতি থাকলেও এডিবি মনে করে, দুর্বল অভ্যন্তরীণ চাহিদা, রাজনৈতিক পালাবদল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি, শিল্পে অস্থিরতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে। বেসরকারি খাতের উন্নয়নকে উৎসাহিত করে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের বাইরেও অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা উচিত। স্থিতিশীল অবকাঠামো বৃদ্ধি, জ্বালানি নিরাপত্তা উন্নত করা, আর্থিক খাতের সুশাসন জোরদার এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রতিযোগিতামূলকতা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এডিবি প্রতিবেদনে আশা করা হয় যে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় আরো মাঝারি হবে। তবে আমরা ২০২৬-২৭ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ চাহিদার উন্নতির সাথে সাথে পুনরুত্থান আশা করছি। ইতোমধ্যে আমরা আশা করছি মুদ্রাস্ফীতি উচ্চ থাকবে। মুদ্রানীতি সম্ভবত কঠোর থাকবে, ক্রমবর্ধমান অ-কার্যকর ঋণসহ ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাগুলো সমাধানের ওপর জোর দেয়া হবে। আর বহিরাগত খাতে, আমরা আশা করছি যে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি কিছুটা কমবে। একইভাবে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি এবং সরকারি পুনরাবৃত্ত ব্যয় বৃদ্ধির প্রত্যাশায় রাজস্ব ঘাটতি ২০২৪ অর্থবছরের কাছাকাছি থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নেতিবাচক ঝুঁকি রয়েছে। জেদী উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, দীর্ঘায়িত আর্থিক কঠোরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রতিকূল আবহাওয়া ঘটনা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক শুল্কের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মূলত রফতানি চাহিদা কমে যাওয়া এবং জ্বালানি ঘাটতির কারণে শিল্পের মন্দা ২০২৩ অর্থবছরে ৮.৪ শতাংশ থেকে ৩.৫ শতাংশে এ নেমে এসেছে। বৃহৎ আকারের উৎপাদন ৮.৪ শতাংশ থেকে ১.০ শতাংশে এ নেমে এসেছে। অন্য দিকে পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য, পরিবহন এবং আর্থিক পরিষেবার দুর্বল কর্মক্ষমতার কারণে পরিষেবা খাত প্রবৃদ্ধি ৫.৪ শতাংশ থেকে ৫.১ শতাংশে এ নেমে এসেছে। আর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কৃষিক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৩.৪ শতাংশ থেকে ৩.০ শতাংশে নেমে এসেছে।
বিদেশী বিনিয়োগের ব্যাপারে এডিবির প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশকে এফডিআই এবং দেশীয় বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য আরো প্রতিযোগিতামূলক গন্তব্যস্থলে পরিণত করার জন্য একটি সুবিন্যস্ত বিনিয়োগ সংস্কার কর্মসূচি প্রয়োজন। সংস্কারের মাধ্যমে লাইসেন্স প্রদান এবং অনুমতি প্রদানের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, ব্যবসায়িক নিয়মকানুন ও পদ্ধতি সহজ করা এবং নীতিগত সমন্বয়সহ সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা উচিত। এই লক্ষ্যে দৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত। বিআইসিআইপির মতো প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি করে পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করা, যা লাল ফিতা কাটা এবং নিয়ন্ত্রক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে।
বাংলাদেশ কর্তৃক অনুমোদিত আন্তর্জাতিক শ্রম মান, মানবাধিকার ও পরিবেশগত কনভেনশনগুলোর সাথে সম্মতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশটিকে দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক আচরণের প্রচারও করতে হবে। বিনিয়োগ সহজীকরণের সংস্কার সম্পর্কে অবহিতকরণ এবং নির্দেশনা দেয়ার জন্য সরকারকে উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ সুবিধা সম্পর্কিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) যৌথ উদ্যোগে যোগদানের কথা বিবেচনা করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। নীতিগত সমন্বয় উন্নত করতে, প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় বৃদ্ধি করতে এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি স্পষ্ট সঙ্কেত পাঠানোর জন্য বিডার সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, যা বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত।