বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৮ শতাংশ হতে পারে

বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি তীব্রভাবে মন্থর, কর্মসংস্থান সৃষ্টি স্থবির এবং উচ্চ অনাদায়ী ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দুর্বল রাজস্ব আদায়ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

  • বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি তীব্রভাবে মন্থর
  • উচ্চ অনাদায়ী ঋণে ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিপূর্ণ
  • কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থবিরতা
  • দুর্বল রাজস্ব আদায় অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বাধা

মূল্যস্ফীতির চাপ কমার ফলে বেসরকারি ভোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর সংস্কার করতে পারলে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। চ্যালেঞ্জের বিষয়টি তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাসের প্রতিবেদনে বলছে, বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি তীব্রভাবে মন্থর, কর্মসংস্থান সৃষ্টি স্থবির এবং উচ্চ অনাদায়ী ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দুর্বল রাজস্ব আদায়ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়। আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যঁ পেম। বক্তব্য রাখেন, সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সিসকা অংসরগ্, জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নাজমুস সাদাত খান, সিনিয়র এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেহরীন আহমেদ মাহবুব।

বিশ্বব্যাংক জানায়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মারাত্মক ব্যাঘাত সত্ত্বেও পরবর্তী প্রান্তিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরে এসেছে। বহিরাগত খাতের চাপ হ্রাস, রিজার্ভ স্থিতিশীলতা এবং মুদ্রাস্ফীতি কমে আসা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে। আর গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় বিনিয়োগের উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে তা মন্থর থাকতে পারে। যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকিং খাতে চলমান দুর্বলতা প্রতিফলিত করে। আর আমদানি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে চলতি হিসাবের ভারসাম্য সামান্য ঘাটতিতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উন্নতির ফলে রাজস্ব বৃদ্ধির কারণে রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে থাকবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

সংস্থাটি বলছে, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শ্রমবাজারের অবস্থার অবনতি হয়েছে। শ্রমশক্তিতে মহিলার অংশ কমছে। শ্রমশক্তির হার কমে এখন ৫৮.৯ শতাংশে। ৩০ লাখ লাখ শ্রমশক্তি এখন শ্রমবাজারের বাইরে। যার মধ্যে ২৪ লাখই নারী। গত অর্থবছর দরিদ্রতার হার সাড়ে ২০ শতাংশ ছিল। যা এখন ২১.২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যবসায় খরচ বেশি হওয়ায় এ দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বেশ কম। এখনো অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। চ্যালেঞ্জগুলো হলো, বিনিয়োগে ভাটা, কর্মসংস্থানে ঘাটতি, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক খাত, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও দুর্বল রাজস্ব আদায়। গত কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি কমলেও এখনো তা অনেক বেশি। গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে, কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়েছে।

নীতি অগ্রাধিকার আরো এবং উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টি : প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি হলো এমন সংস্কার বাস্তবায়ন করা। যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রতিযোগিতামূলকতাকে শক্তিশালী করে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য আরো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে এবং আরো ও উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করে। এর জন্য প্রয়োজন হবে-বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা, বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের বিধিনিষেধ হ্রাস করা, অর্থায়নের সুযোগ উন্নত করা, বিরোধ নিষ্পত্তি করা এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা।

ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং স্থিতিস্থাপকতা তৈরি : আর্থিক সুরক্ষা জাল এবং সঙ্কট ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ, কার্যকর ব্যাংক পুনর্গঠন এবং খেলাপি ঋণ দ্রুত নিষ্পত্তি করা করতে হবে। করপোরেট সুশাসন উন্নতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যকে সুশৃঙ্খল এবং স্থায়ীভাবে পুনরুদ্ধার করা।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের উন্নতি : বাংলাদেশের রাজস্ব ও জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। সরকার কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্কার শুরু করেছে (যেমন, করনীতি এবং কর প্রশাসন পৃথকীকরণ, কর ব্যয় হ্রাস ইত্যাদি)। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা এবং দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বব্যাংক করণীয় সম্পর্কে বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয় পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ শক্তিশালীকরণ। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে- বিশ্লেষণের মাধ্যমে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শক্তিশালী করা। প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় ব্যবস্থার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর (যেমন, পরিবহন, সরবরাহ, অর্থনৈতিক অঞ্চল) জন্য মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং সেক্টরাল মাস্টার প্ল্যান হালনাগাদ করা। কৌশলগত পরিকল্পনা এবং বাজেট প্রক্রিয়ার একীকরণ ত্বরান্বিত করা। উপজেলা অফিসগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের ক্রমবর্ধমান অংশ অর্পণ করা। নগর স্থানীয় সরকারগুলোকে তাদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ক্ষমতায়ন করা।

বিশ্বব্যাংক বলছে, নগর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে (ইউএলজিআই) তাদের রাজস্ব প্রশাসন উন্নত করার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়তা প্রদান করা। স্থানীয় সরকার বিভাগের এডিপি ব্লক অনুদান বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। ব্লক অনুদান বরাদ্দের জন্য সূত্র-ভিত্তিক এবং জনসংখ্যাভিত্তিক বরাদ্দ ব্যবহার করা।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যঁ পেম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক সময়ে দৃঢ়তা দেখিয়েছে। টেকসই প্রবৃদ্ধি ও ভালো কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশকে সাহসী সংস্কার ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করা, জ্বালানি ভর্তুকি কমান, নগরায়ন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করার ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে।