সীমিত পরিসরে খুলছে মাইলস্টোন

ক্যাম্পাসজুড়ে পোড়া গন্ধ কাঁদল সহপাঠীরা

আগামী বুধবার থেকে শুরু হবে পাঠদান

এস এম মিন্টু
Printed Edition

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহু দুর্ঘটনা ঘটে রাজধানীর দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছড়ে পড়ে। বিমানটি শিশুদের একটি ক্যাম্পাসে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা কমলমতি শিশুদের শরীর ঝলসে দেয়। চার পাশে ছড়িয়ে পরে কান্নার রোল। আগুনে ঝলসে শিশু শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও কর্মচারীসহ প্রাণ হারায় ৩৫ জন। অন্তত দুই শতাধিক আহত হলেও এখনো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালে ভর্তি আছেন অনেকে। তবে আগুন নিভে গেলেও মাইলস্টোন ক্যাম্পসে পোড়া গন্ধ যেন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। গতকাল ১৪ দিনের মাথায় সীমিত পরিসরে ক্যাম্পাস খুললেও ক্যাম্পাসে পোড়া গন্ধ এখনো যায়নি। নিহতদের স্মরণে ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠেন সহপাঠীরা।

আজ ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার ১৫ দিন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ গতকাল থেকে সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে ক্লাসের কার্যক্রম। তবে পাঠদান হয়নি। ক্যাম্পাসের ভেতরে যেখানে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয় সেটিকে ঘিরেই সহপাঠীরা ঘিরে রাখেন। যদিও বর্তমানে নীল রঙের টিন দিয়ে ঘিরে রাখা ভবনটির চার পাশ। কলেজে আসা শিক্ষার্থীরা সেই টিন দিয়ে ঘেরা ভবনের সামনেই নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকে। শোকে কান্না করে।

গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা। তবে নেই সেই চিরচেনা কোলাহল। কারো মুখে কোনো কথা নেই, কেউ কেউ সোজা চলে যাচ্ছে সেই টিনঘেরা অংশের কাছে। অনেকে নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কেউ নীরবে চুপচাপ চোখ মুছছে। আশপাশে টহল দিচ্ছেন কয়েকজন কলেজকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষী।

গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও কর্মচারীদের স্মরণে আয়োজন করা হয় শোকসভা ও দোয়া মাহফিলের। এই আয়োজন ঘিরে পুরো কলেজ অডিটোরিয়ামে সৃষ্টি হয় আবেগঘন পরিবেশের। নিহতদের জন্য দোয়া করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। শিশুদের কান্নায় শিক্ষকরাও তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাইলস্টোনের আকাশ তখন ভারী। সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক পরিবেশের। প্রথমে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। পরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, এই দুর্ঘটনা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। আমরা কেবল শিক্ষার্থী হারাইনি, হারিয়েছি পরিবারের সদস্যদের। এই শোক কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়, কিন্তু একে-অপরের পাশে থাকলে আমরা সহজেই ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে অধ্যক্ষ বলেন, এই শোক কেবল সংখ্যা দিয়ে বোঝানো যাবে না। এই শোক কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। কিন্তু আমরা যদি একে অপরের পাশে থাকি, তাহলে এই দুঃসময় থেকেও বেরিয়ে আসতে পারব।

যা বললেন শিক্ষার্থীরা : দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সামিরা ইসলাম বলেন, এই ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে ক্লাসে যেতাম, আজ সেখানে শুধুই পোড়া গন্ধ আর শূন্যতা। আজকে কোনো ক্লাস হয়নি। আমরা শুধু পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময়ের জন্য এসেছি। রবিউল ইসলাম নামের একাদশ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে পা রাখতেই চোখে পানি এসে গেলো। এই মাঠে একসাথে কত হাসিখুশি সময় কেটেছে আমাদের। আজ সব স্তব্ধ। আমার সহপাঠীরা আর ফিরে আসবে না ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে আসে। দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাহিন আল রাব্বি বলেন, এই ভবনেই শিশুদের ক্লাস হতো। এখনো বিশ্বাস হয় না, যেখানে তারা ক্লাস করত সেটা এখন একটা বিধ্বস্ত কাঠামো। আমরা প্রতিদিন যেটাকে ভবিষ্যতের সিঁড়ি ভাবতাম, সেটা এখন স্মৃতির ভার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরেক শিক্ষার্থী রাইশা তাবাসসুম বলেন, কোনোভাবেই দুর্ঘটনার কথা ভুলতে পারছি না। আমরা অনেক বেশি শোকাহত। দীর্ঘদিন মনের মধ্যে এই দুর্ঘটনার কথা গেঁথে থাকবে।

মাইলস্টোন কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল জানান, শিক্ষার্থীরা যেন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, এ জন্যই সীমিত পরিসরে ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা কলেজে এসে শিক্ষকদের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের সুযোগ পাবে, বন্ধুদের সাথে সময় কাটাবে। মানসিক প্রশান্তি ফিরে পেতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তিনি বলেন, কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর সহায়তায় একটি চিকিৎসা ক্যাম্প চালু আছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কলেজের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে কাউন্সিলিং চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ চাইলে ব্যক্তিগতভাবে একান্ত আলাপের সুযোগও পাচ্ছেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক সমাজের পারস্পরিক সহানুভূতি ও মানবিকতা এই সঙ্কটময় সময়ে কলেজের বড় শক্তি হয়ে উঠেছে বলেও জানান তিনি।

আগামী বুধবার থেকে শুরু হবে পাঠদান : আগামী ৬ জুলাই (বুধবার) থেকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে।

ট্রমা কাটাতে যেকোনো শাখায় বদলি : মাইলস্টোন কলেজে বিমান দুর্ঘটনার ঘটনায় ট্রমায় থাকা শিক্ষার্থীরা চাইলেই অন্য যেকোনো শাখায় বদলি হতে পারবে। আবার কেউ চাইলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা কর্নেল (অব:) নুরুন নবী। গতকাল বিকেলে কলেজ ক্যাম্পাসে তিনি আরো বলেন, যদি কোনো শিক্ষার্থী এখান থেকে অন্য কোনো ক্যাম্পাস বা শাখায় যেতে চায়, তবে অভিভাবকদের আমরা বলেছি, তাদের যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যান। তবে এমন জায়গায় নিয়ে যান যেখানে তার বন্ধু-বান্ধব আছে, যেন সে মানসিক স্বস্তি খুঁজে পায়।

দুর্ঘটনায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে নুরুন নবী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খুব সহযোগিতা করছে। ইতোমধ্যে ভারত, চীন ও সিঙ্গাপুর থেকে দক্ষ চিকিৎসক আনা হয়েছে। এ ধরনের মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠতে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন, সরকার সেটা নিশ্চিত করছে।

প্রসঙ্গত, গত ২১ জুলাই দুপুরে উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৫ জন নিহতের তথ্য পাওয়া গেছে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা: শাওন বিন রহমান জানান, এই পর্যন্ত মোট ৯ জনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আমাদের এখানে ২৮ জনের চিকিৎসা চলছে। তাদের সবার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। আমরা আশা করছি অন্য যারা আমাদের এখানে ভর্তি আছে, তারাও সুস্থ হয়ে শিগগিরই বাড়ি ফিরতে পারবে। যাদের ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে, তারা পরবর্তী সময়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে এসে চিকিৎসা নিতে পারবে। প্রয়োজনে অপারেশনও করাতে পারবে।