মাউশি ভেঙে ২টি অধিদফতরের প্রস্তাব

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition
  • শিক্ষা ক্যাডারের ১৮ হাজার কর্মকর্তার অসন্তোষ
  • আওয়ামী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বলছেন অনেকে

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) ভেঙে পৃথক দু’টি স্বতন্ত্র অধিদফতর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে। ‘মাধ্যমিক অধিদফতর’ ও ‘কলেজ শিক্ষা অধিদফতর’ নামে এই দু’টি অধিদফতর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনাও ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে প্রেরণ করা হয়েছে। গত ৩ জুলাই প্রস্তুতকৃত ওই প্রস্তাবনায় শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা শিক্ষাসচিব সিদ্দিক জোবায়ের স্বাক্ষর করে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে প্রেরণ করেন ।

এ দিকে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমন একটি প্রস্তাব আওয়ামী সরকারের আমলে নেয়া হয়েছিল বটে কিন্তু পরে শিক্ষা কর্মকর্তাদের জোর আপত্তি এবং পরিকল্পনাটি বাস্তবসম্মত ছিল না বলেই পরবর্তীতে সেটি স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ এর ৫ আগস্ট পরবর্তী দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্বেকার সেই অবাস্তব চিন্তাটিই এখন আবার নতুন করে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। ইতোমধ্যে এমন একটি প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার দফতরেও পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতর থেকেও তীব্র আপত্তি আর প্রতিবাদ আসছে।

শিক্ষা সেক্টরের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, তীব্র আপত্তি থাকার পরও শিক্ষা নিয়ে আলাদা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করার মধ্যে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসরদের গোপন কোনো মিশন রয়েছে কি না সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। তারা বলছেন বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হয়। সেখানে ২৭ নম্বর অধ্যায়ের ৬ নম্বর পয়েন্টে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরকে দুইভাগ করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদফতর নামে দু’টি আলাদা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মাউশির বিভক্তি ও দুটো আলাদা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ মূলত ফ্যাসিস্ট সরকারেরই এজেন্ডা বাস্তবায়ন বলেই মনে করছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।

অন্য দিকে বিতর্কিত ওই শিক্ষানীতির চতুর্থ অধ্যায়ে (মাধ্যমিক শিক্ষা) বলা হয়েছে, নবম-দ্বাদশ শ্রেণী মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর হিসেবে বিবেচিত হবে। অধ্যায়ের ৬ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে বর্তমান উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী সংযোজন করা হবে এবং উচ্চমাধ্যমিক কলেজগুলোতে নবম ও দশম শ্রেণী খোলা হবে। শিক্ষা সেক্টরের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই প্রতিবেদককে জানান, ফ্যাসিস্ট আমলের শিক্ষানীতি অনুযায়ী মাধ্যমিক আলাদা অধিদফতর হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এক জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি হবে। উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী যুক্ত হলে সেগুলোর নাম নিশ্চয়ই স্কুল থাকবে। আবার কলেজগুলোতে নবম-দশম শ্রেণী চালু হলে কি কলেজের নাম পরিবর্তন হয়ে স্কুল হয়ে যাবে? উচ্চবিদ্যালয়ের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বা কলেজগুলোর নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কারা পড়াবেন? বর্তমানে যদিও বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা মূলত সরকারি কলেজগুলোতেই যোগদান করেন। সরকারি কলেজ বলতে উচ্চমাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্তই বোঝানো হয়ে থাকে। আবার মাধ্যমিক আলাদা অধিদফতর হলে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মের ক্ষেত্রই হয়তো সীমিত হয়ে পড়বে।

বিতর্কিত শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী এইচএসসি পর্যন্ত যদি মাধ্যমিক শাখার অংশ হয় তাহলে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীকে পড়ানোর কথা মাধ্যমিকের শিক্ষকদের। স্কুলগুলোর উচ্চতর এবং কলেজগুলোর নিম্নতর সম্প্রসারণ হলে দুই প্রতিষ্ঠানেরই ৯ম-১২ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পড়াবেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকগণ। অন্যদিকে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজকে নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে উচ্চশিক্ষায়ও শিক্ষা ক্যাডারের সুযোগ সীমিত হচ্ছে। অন্যান্য বিভাগীয় কলেজগুলো স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হলে বা নিকটস্থ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলে সেই সুযোগ আরো কমবে। মাধ্যমিক আলাদা অধিদফতর হলে শিক্ষাবোর্ডগুলোতেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। শিক্ষাবোর্ডগুলোতে শিক্ষা ক্যাডারের পদ বিলুপ্ত হবে। বোর্ডগুলো তখন হয়ে যাবে মাধ্যমিকের শিক্ষকদের। একইসাথে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা তখন সরকারি কলেজ নয়, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলো পরিচালনা করবে। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নও তখন তারাই করবে। মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে তখন দু’টি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনারও দায়িত্ব থাকবে। অনুরূপভাবে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী যদি মাধ্যমিকের অংশ হয় তাহলে কলেজের অধিক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবে। কলেজের সংজ্ঞায় তখন পরিবর্তন করতে হবে। কলেজ থেকে এইচএসসিকে তখন বাদ দিতে হবে।

অর্থাৎ সামগ্রিক বিচারে মাধ্যমিক আলাদা অধিদফতর হলে শিক্ষা খাতে এক বিশাল বিশৃঙ্খলা ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। মাধ্যমিক শাখার শিক্ষকবৃন্দকে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে একটি মহল এই ষড়যন্ত্রে নেমেছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। তবে এখানে উল্লেখ্য, মাধ্যমিক শাখায় হয়তো কিছু সমস্যা আছে, শিক্ষকদের হয়তো ক্ষোভ আছে, কিছু দাবি আছে। কিন্তু সেজন্য অধিদফতর ভেঙে দুই টুকরো করতে হবে কেন? আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যায়। মাউশির জনবল বাড়িয়েই উন্নততর সেবা নিশ্চয়ই করা যায়। আলাদা অধিদফতর মানে শুধু নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, তাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছু হয় না। প্রাথমিক কিন্তু আলাদা অধিদফতর না, আলাদা মন্ত্রণালয় হয়েছে। মাদরাসা ও কারিগরিও আলাদা অধিদফতর হয়েছে। এসব সেক্টরে কি শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়েছে? প্রাথমিক শিক্ষার মান কমতে কমতে আজকে তলানিতে।

এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার মর্যাদা রক্ষা কমিটির সভাপতি এস এম কামাল আহমেদ নয়া দিগন্তকে জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরকে দ্বিখণ্ডিত করতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলের আমলারা ২০১০ সালের পর থেকে ক্রমাগত চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ সচিব সিদ্দিক জুবায়ের তার পদ থেকে বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টার নিকট এরকম একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যা শিক্ষা ক্যাডারের সাথে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই। এই ধরনের পৃথক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর তৈরি চেষ্টা করা হলে শিক্ষা ক্যাডারের পক্ষ থেকে জোরালো কর্মসূচি দেয়া হবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এই চেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ করারও দাবি জানাই।

অপরদিকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল নয়া দিগন্তকে বলেন, অংশীজনদের সাথে কোনো রকম আলাপ আলোচনা না করেই মাউশিকে পৃথকীকরণের এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষা ক্যাডারের ১৮ হাজারের অধিক কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এতে শিক্ষা সেক্টরে সমন্বয়হীনতা তৈরিরও আশঙ্কা রয়েছে। আবার শিক্ষা ক্যাডারের লোকজনের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়াও তৈরি হবে। কেননা ইতোমধ্যে ফেজবুকে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি চলছে। সরকারকে সবদিক বিবেচনায় নিয়েই সামনে দিকে এগোতে হবে।