গাজায় অন্তহীন মৃত্যুর চক্রে বেসামরিকরা : গুতেরেস

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস |সংগৃহীত
  • ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইনি দায়িত্বের ‘কোনোটিই’ পূরণ করছে না
  • আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত
  • ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিতে প্রস্তুত ইন্দোনেশিয়া
  • ৭০ শতাংশ পানি সরবরাহ বন্ধ

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজার বেসামরিক নাগরিকরা অন্তহীন মৃত্যুর চক্রে রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ফিলিস্তিনের এই উপত্যকাকে মৃত্যুপুরী বলে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছেন গুতেরেস। এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু।

বার্তাসংস্থাটি বলছে, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গাজা উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন এবং গাজায় মানবিক সাহায্যের সরবরাহের ওপর ইসরাইলি অবরোধের নিন্দা জানিয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, ‘এক মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় এক ফোঁটাও সাহায্য আসেনি। খাবার নেই। জ্বালানি নেই। ওষুধ নেই। বাণিজ্যিক সরবরাহ নেই। সাহায্য শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, ভয়াবহতার দ্বার আবার খুলে গেছে। গাজা এক মৃত্যুপুরী এবং সেখানকার বেসামরিক নাগরিকরা অন্তহীন মৃত্যুর চক্রে রয়েছেন।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, মানবিক বিরতির ফলে গুরুত্বপূর্ণ ত্রাণ প্রচেষ্টা পরিচালনার পাশাপাশি বন্দীদের মুক্তি সম্ভব হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘সর্বোপরি, আমরা জানি যুদ্ধবিরতি ভালো ফল বয়ে আনে।’ গুতেরেস এ দিন জেনেভা কনভেনশনের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন। এই কনভেনশন যুদ্ধের সময় যেকোনো দখলদার শক্তিকে খাদ্য, চিকিৎসা সেবা এবং জনস্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে বাধ্য করে।

গুতেরেস বলেন, ‘দখলদার শক্তি হিসেবে, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইসরাইলের দ্ব্যর্থহীন বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও রয়েছে।’ জাতিসঙ্ঘের এই মহাসচিব আরও বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরাইলকে ত্রাণ পরিকল্পনায় সম্মত হতে হবে এবং গাজার বেসামরিক জনগণের কাছে সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি দিতে হবে। তবে তিনি বলেন, ‘আজ এর কিছুই হচ্ছে না। কোনো মানবিক সরবরাহ গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। এ দিকে ক্রসিং পয়েন্টে, খাদ্য, ওষুধ এবং আশ্রয় সরঞ্জাম ও পণ্যের সরবরাহ কেবলই স্তূপীকৃত হচ্ছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম আটকে আছে।’ গুতেরেস গাজার মানবিক কর্মীদের ‘বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। মূলত এসব কর্মী সহায়তা প্রদানের জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাজায় কাজ করে চলেছেন।

ইসরাইলি হামলায় আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত

আলজাজিরা জানায়, গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলায় আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের ছয় সদস্য রয়েছেন। ফলে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৫০ হাজার ৮১০ ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ ও মানব উন্নয়নে সহায়তার সাথে সম্পর্কিত ছয়টি স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরাইলি বাহিনী বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে কমপক্ষে আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় শহর বেইত লাহিয়ায় একটি বাড়িতে ইসরাইলের বিমান হামলায় একই পরিবারের ছয় সদস্য নিহত হয়েছেন। এ দিকে উত্তর-পশ্চিম গাজা শহরের একটি আশ্রয় কেন্দ্রের কাছে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বিমান হামলায় আরো চারজন নিহত হয়েছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পশ্চিম গাজা শহরের আরেকটি হামলায় সাবেক একজন ফুটবল খেলোয়াড়ও নিহত হয়েছেন। গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরাইল পুনরায় হামলা শুরু করার পর থেকে চার লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিতে প্রস্তুত ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো বলেছেন, গাজায় যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে তার দেশ প্রস্তুত। বুধবার মধ্যপ্রাচ্য ও তুরস্ক সফরে রওনা হওয়ার আগে তিনি জানান, প্রথম পর্যায়ে গাজার প্রায় ১,০০০ ফিলিস্তিনিকে আশ্রয় দেয়া হতে পারে। আহত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং অনাথদের অস্থায়ীভাবে ইন্দোনেশিয়ায় এনে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

‘আমরা আহতদের, মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের এবং অনাথদের সরিয়ে আনতে প্রস্তুত। তারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে এবং গাজায় ফেরার মতো নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি হলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে’ বলেন প্রাবোও। তিনি জানান, কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের ইন্দোনেশিয়ায় সরিয়ে নেয়া যায় তা নিয়ে ফিলিস্তিনি ও অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করার জন্য তিনি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ নয়, তবে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান থেকেই ইন্দোনেশিয়া সঙ্ঘাত নিরসনে তার ভূমিকা বাড়াতে চায়। রয়টার্স জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্থায়ীভাবে ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়ার পর ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফিলিস্তিনিদের জোর করে বাস্তুচ্যুত করার প্রচেষ্টা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করার দুই মাস পর প্রাবোও এ প্রস্তাব দিলেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট এর আগেও বলেছিলেন, প্রয়োজনে গাজায় শান্তিরক্ষী সেনা পাঠাতে প্রস্তুত তার দেশ।

৭০ শতাংশ পানি সরবরাহ বন্ধ, ভয়াবহ সঙ্কটে গাজা

ইসরাইলি কোম্পানি মেকোরোট গাজা উপত্যকায় পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অবরুদ্ধ উপত্যকাটির মোট পানি সরবরাহের ৭০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। গাজা পৌরসভার মুখপাত্র হোসনি মেহান্নার জানিয়েছেন, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে পূর্ব গাজা শহরের শুজাইয়া পাড়ায় অবস্থিত প্রধান পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেখানে গত বৃহস্পতিবার থেকে ইসরাইলি বাহিনী সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। মেহান্না তুর্কি গণমাধ্যম আনাদোলুকে বলেন, এই বিঘে্নর কারণগুলো এখনও স্পষ্ট নয়। তবে আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করছি যাতে এলাকায় ইসরাইলি বোমাবর্ষণের কারণে পাইপলাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা যায়। তিনি আরও বলেন, এই বিঘ্ন সরাসরি সামরিক কার্যকলাপের কারণে হতে পারে অথবা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে হতে পারে। মেহান্না সতর্ক করে বলেছেন, কারণ যাই হোক না কেন এর পরিণতি ভয়াবহ। যদি মেকোরোট থেকে পানিপ্রবাহ শিগগিরই চালু করা না হয়, তাহলে গাজা ভয়ঙ্কর পানি সঙ্কটের মুখোমুখি হবে। বছরের পর বছর ধরে অবরোধ, অবকাঠামোগত ধস এবং ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের কারণে গাজা ইতোমধ্যেই বিশুদ্ধ পানির দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটে ভুগছে, মানবিক পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকায় এখন ব্যাপক পানিশূন্যতার ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে।