জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে খরা, বর্ষা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি মাথায় রেখেই আগামীতে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ সবধরনের অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী মো: আব্দুর রশীদ মিয়া।
তিনি বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা ‘ক্লাইমেট রেজিলেন্স স্ট্রাকচার’-এর দিকে যাচ্ছি। এলজিইডির এই প্রধান প্রকৌশলী বলেন, বিগত বছরগুলোতে দেশে সমন্বিত উন্নয়ন হয়নি। অনেক এলাকা বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে উন্নয়নে বৈষম্য হয়েছে। পিছিয়ে পড়া অনুন্নত এলাকায় নতুন কিছু প্রকল্প নিতে প্রকল্প প্রণয়ণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছি।
মো: আব্দুর রশীদ মিয়া বলেন, আমাদের (এলজিইডি) প্রায় চার লাখ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার রাস্তা পাকা করা হয়েছে। এখনো আড়াই লাখ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা কাঁচা আছে। এখন যেভাবে কাজ চলছে এসব রাস্তা পাকা সম্পন্ন করতে আরো ২৫-৩০ বছর লাগবে। এ জন্য এলজিইডিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান দেশের গ্রামীণ রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করা এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী। গত ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে নিয়োগ পান। ৩৬ বছরেরও বেশি কর্মজীবনে আব্দুর রশীদ সর্বশেষ অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মানব সম্পদ উন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দৈনিক নয়া দিগন্তকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারটি নিচে দেয়া হলো-
নয়া দিগন্ত : চলমান অর্থবছরে এলজিইডির বাজেট কত ছিল এবং অগ্রগতি কী?
প্রধান প্রকৌশলী : ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলজিইডির সংশোধিত বাজেটে বরাদ্ধ ছিল ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ব্রিজ, কালভার্ট, বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নকাজ আমরা হাতে নিয়েছি। এ পর্যন্ত আমাদের আর্থিক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ।
নয়া দিগন্ত : গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে চলমান কাজের কতটুকু সম্পন্ন করতে পেরেছেন?
প্রধান প্রকৌশলী : গ্রামীণ হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণের চলমান কাজগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত যে টার্গেট রয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ হয়তো সম্পন্ন হবে। প্রতি বছর প্রায় এ রকমই অগ্রগতি হয়।
নয়া দিগন্ত : গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নে কিভাবে কাজ করছে এলজিইডি?
প্রধান প্রকৌশলী : জিডিপির একটা অংশ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ গ্রামের যে কৃষক, তাদের উৎপাদিত পণ্যের যদি ন্যায্যমূল্য পায়-সেই ন্যায্যমূল্য পাওয়ার পূর্ব শর্ত হলো যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকা। ঢাকা বা শহর থেকে যারা পাইকারি ক্রেতা, তারা যদি সরাসরি গ্রামীণ হাটবাজার থেকে কিনে নিয়ে আসে তাহলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে। এলজিইডি ওই জায়গাতেই কাজ করছে। গ্রামীণ যোগাযোগ ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, হাট-বাজার উন্নয়নে এলজিইডি কাজ করছে।
নয়া দিগন্ত : প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে রাস্তাঘাট নষ্ট হচ্ছে, সেটি কতটুকু রিপেয়ারিং করতে পারছেন?
প্রধান প্রকৌশলী : যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা, বর্ষা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের সেই ধরনের স্ট্রাকচার তৈরি করা দরকার। এটাকে বলে ক্লাইমেট রেজিলেন্স স্ট্রাকচার। আমরা ক্লাইমেট রেজিলেন্স স্ট্রাকচারের দিকেই যাচ্ছি। ডিজাইনটা সেভাবেই করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আগে যে স্ট্রাকচারগুলো (রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ) হয়েছিল, সেগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়- এগুলোতে যে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য পল্লøী অবকাঠামো ও মেরামত কর্মসূচি রয়েছে আমাদের। এই কর্মসূচির আওতায় আমরা তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলাম। এই মেরামতের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৯০ শতাংশ।
নয়া দিগন্ত : একটা অর্থবছর বিদায় নিচ্ছে। আরেকটি আসছে। বিদায়ী অর্থবছরে কোন কোন দিকে নজর ছিল?
প্রধান প্রকৌশলী : যে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছিল, চলমান অর্থবছরে সেগুলোই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আর কিছু প্রকল্প ছিল যেগুলোর কাজ শুরু হয়নি, ডিপিপিভুক্ত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প; সেগুলো আমরা সংশোধন করে অধিক বা জনগুরুত্বপূর্ণ চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে যেখানে উন্নয়ন কম হয়েছে, সমন্বয় করার চেষ্টা করছি। আর নতুন অর্থবছর বা ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে যেখানে উন্নয়নটা কম হয়েছে, সেখানে নতুন কিছু প্রকল্প নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
নয়া দিগন্ত : উন্নয়নবঞ্চিত এলাকা চিহ্নিত করেছেন কি না?
প্রধান প্রকৌশলী : উন্নয়ন কম হওয়া এলাকার মধ্যে উত্তরবঙ্গের কিছু জেলা রয়েছে। আবার একটা জেলার ভেতরে হয়তো পাঁচটা উপজেলা আছে, তিনটার ডেভেলপমেন্ট বেশি হয়েছে, দু’টি কম হয়েছে; সেগুলো আমরা চিহ্নিহ্নত করেছি।
নয়া দিগন্ত : এলজিইডিতে দীর্ঘ দিন ধরে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, এটা কিভাবে কাটিয়ে উঠছেন?
প্রধান প্রকৌশলী : আমাদের এখানে প্রকল্প মনিটরিং ও মূল্যায়ন নামের একটা ইউনিট আছে। সেই ইউনিটের মাধ্যমে সারা দেশের ২০টি অঞ্চল, দুই-তিনটি জেলা নিয়ে এই অঞ্চল। সদর দফতরে কর্মরতদের নিয়ে গঠিত ২০টি অঞ্চলের জন্য একটি পরিদর্শন টিম আছে, এই টিমের মাধ্যমে ফিজিক্যালি এবং দ্বৈব চয়নের মাধ্যমে র্যামডম স্যাম্পলিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার কাজ পরিদর্শন করা হয়। কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলী বা নির্বাহী প্রকৌশলীকে আমরা শোকজ করছি। ঠিকাদারের পেমেন্ট বন্ধ করে দিয়ে যে কাজগুলো সংশোধন করা দরকার, সেটি সংশোধন করছি। তারপর বিল প্রদান করছি। ইতোমধ্যে আমাদের ডিসিপ্লিনারি ইউনিট আছে (শৃঙ্খলা ও তদন্ত)। যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা/বিভাগীয় মামলা দায়ের করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অনিয়ম- দুর্নীতি যাতে রোধ করা যায় সে প্রচেষ্টা আমাদের আছে।
নয়া দিগন্ত : এলজিইডির কার্যক্রম কি আরো বাড়ানো উচিত? অভিজ্ঞতার আলোকে যদি বলেন, আগামীতে এলজিইডিকে মানুষ কিভাবে দেখতে চায়...
প্রধান প্রকৌশলী : আমি একটা পরিসংখ্যান দিই, সড়ক ও জনপথ বিভাগের সারা দেশে মাত্র ৩২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা। আর আমাদের (এলজিইডি) প্রায় চার লাখ কিলোমিটার রাস্তা। এর মধ্যে এক লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার রাস্তা পাকা করা হয়েছে। এখনো আড়াই লাখ কিলোমিটারের বেশি কাঁচা রাস্তা আছে, যেগুলো পাকা করার চাহিদা রয়েছে। প্রত্যেকেই চায় যে, তার নিজের গ্রামের রাস্তাটা পাকা হোক। আমরা হিসাব করে দেখেছি যে, এখন যেভাবে (হারে) রাস্তা পাকা করছি, এই হারে যদি পাকা করতে যাই, তাহলে বাংলাদেশের সব রাস্তা পাকা করতে আরো ২৫-৩০ বছর লাগবে। এটা গেল আমাদের ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে যে কাঁচা রাস্তা পাকা হচ্ছে, এটা কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ করা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই হিসেবে আমাদের কাজের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ জন্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এসব বিচার-বিশ্লেষণ করে এবং স্টেক হোল্ডার কনসাল্ট্যাশন করে গ্রামের বিভিন্ন লোকের সাথে আলাপ আলোচনা করে কাজের (এলজিইডি) আওতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। তারা সুপারিশ করেছে যে, আমাদের অফিস ইউনিয়ন পর্যন্ত যাবে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের আওতায় একজন উপ সহকারী প্রকৌশলী বা একজন সহকারী প্রকৌশলী থাকবে। ইউনিয়নে একটা ছোট প্রকৌশলী সেটাপ থাকবে। উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে যাতে তারা পরিকল্পিতভাবে রুট লেভেলের কাজগুলো করতে পারে- এ জন্য সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে এবং এই পরিকল্পনাটা আছে।
নয়া দিগন্ত : আগামী দিনে এলজিইডির উন্নয়ন ভাবনা কী?
প্রধান প্রকৌশলী : বিগত দিনে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা সমভাবে হয়নি। কিছু এলাকায় উন্নয়নটা কম হয়েছে। উন্নয়নে বৈষম্য হয়েছে। যেসব এলাকায় উন্নয়ন কম হয়েছে, বৈষম্য হয়েছে- আমাদের পরিকল্পনা হলো ওই সব এলাকায় স্পেশাল কিছু প্রজেক্ট নিয়ে পিছিয়ে পড়া অংশটাকে উন্নয়নে সমানভাবে শামিল করার উদ্যোগ নেয়া। এ জন্য অনুন্নত এলাকা, যেখানে উন্নয়ন কম হয়েছে, নতুন কিছু প্রকল্প নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এবং আমরা সেভাবেই কিছু প্রকল্প প্রণয়নের কাজও ইতোমধ্যে শুরু করেছি।