গণভোটে শঙ্কা বাড়ছে, ভরসা সরকারি প্রচারণাতে

৩০০ উপজেলায় মানুষের দুয়ারে পৌঁছাবে ‘ভোটের গাড়ি-সুপার ক্যারাভান’

কাওসার আজম
Printed Edition

দেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রথমবারের মতো একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ কার্যকর করার জন্য আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি গণভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

গণভোটের শঙ্কা ও রাজনৈতিক জটিলতা : গণভোটকে ঘিরে সরকারের আশাবাদ থাকলেও রাজনৈতিক বিভাজন, প্রশ্নের জটিলতা, সময় স্বল্পতা এবং নেতিবাচক প্রচারণা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি গণভোটে ‘না’ জয়ী হয়, তবে শুধু জুলাই সনদের বৈধতা নয়, পুরো জুলাই অভ্যুত্থানই প্রশ্নের মুখে পড়বে, যা দেশে নতুন রাজনৈতিক সঙ্কটের সূত্রপাত করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকায় গণভোটের ‘হ্যাঁ’ সূচক তৈরি করতে সরকারের জনসচেতনতা প্রচারণা ভরসা।

জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ : এর পরিপ্রেক্ষিতে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। জনসচেতনামূলক প্রচার কার্যক্রমের মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ, যিনি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (উপদেষ্টা পদমর্যাদা)।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দীর্ঘ সংলাপ, মতভেদ সামাল দেয়া, সনদের খসড়া চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় মুখ্য সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জনসচেতনতা কার্যক্রমের দায়িত্বও তার হাতে থাকা তাৎপর্যপূর্ণ।

ভোটের গাড়ি-সুপার ক্যারাভান : গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন প্রচারণা জোরদার করতে সারা দেশে যাত্রা শুরু করেছে ১০টি ‘ভোটের গাড়ি-সুপার ক্যারাভান’।

উদ্বোধন : জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা: ফিতা কেটে এর উদ্বোধন করেছেন: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম

লক্ষ্য : ৬৪ জেলা ও ৩০০ উপজেলা ভ্রমণ করে সচেতনতা তৈরি : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘ভোটাধিকার কারও দয়া নয়; এটি নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। সুপার ক্যারাভান কেবল গাড়ির বহর নয়, এটি গণতন্ত্রের আনন্দবাণী বহনকারী প্রতীক। এটি ভোটের গুরুত্ব বোঝাবে এবং অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে।’

বাস্তব চ্যালেঞ্জ : গণভোটে চারটি প্রশ্ন থাকলেও ভোটারকে দিতে হবে একটি মাত্র উত্তর- ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’; ভোটের ভাষা ও কাঠামো সহজবোধ্য নয়; সময় সীমিত: ভোট গ্রহণের সময় মাত্র এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে; কোনো ভোটকেন্দ্রে সমস্যা হলে গণভোটও স্থগিত হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন ভোটারদের জন্য বিভ্রান্তিকর। এক বা দুই প্রস্তাবে সমর্থন থাকলেও অন্যটিতে না থাকলে আলাদা মত প্রকাশের সুযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভোটার ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা : দেশে তিন ধরনের ভোটার রয়েছেন: শহর ও শিক্ষিত অংশ- সচেতনভাবে ভোট দেবেন; রাজনৈতিক দলের নির্দেশে ভোট দেবেন; অনির্দিষ্ট বা ভোট থেকে বিরত থাকবেন; রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানও গণভোটকে অনিশ্চিত করছে: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা ৩০টি দল সনদে স্বাক্ষর পেয়েছে; আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ; কিছু বাম দল অভ্যুত্থানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে আর এনসিপি ও চারটি বাম দল এখনো সনদে স্বাক্ষর করেননি।

এই পরিস্থিতিতে ‘না’ ভোট জয়ী হলে জুলাই সনদ বৈধতা হারাবে। তখন সরকার তার সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের মর্জির ওপর নির্ভর করবে।

গণভোটের মূল প্রশ্ন : ‘আপনি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ এবং নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করছেন কি না?’

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান; দুই কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ ও উচ্চকক্ষ গঠন; নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটি সভাপতি নির্বাচন; মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য সংবিধান সংশোধন ও সংস্কার বাস্তবায়ন।

প্রস্তুতি ও প্রচারণা : সরকার ও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোটে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে: সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন ও গণযোগাযোগ অধিদফতর যৌথভাবে আধুনিক প্রচারণা চালাচ্ছে; আঞ্চলিক ভাষায় ৩৪টি গান তৈরি, হাটবাজার ও গ্রামাঞ্চলে পরিবেশন এবং হ্যাঁ-না ভোটের পদ্ধতি ডেমো, রঙিন ব্যালট ব্যবহারের মাধ্যমে ভোটার বিভ্রান্তি কমানো।

ইতিহাসে প্রথমবার একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গণভোট শুধু আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং জুলাই অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্র সংস্কারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের পরীক্ষাও বটে। ফলাফল ‘হ্যাঁ’ হলে সরকার বৈধতা পাবে, ‘না’ হলে দেশের রাজনৈতিক পথচলা নতুন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।