আমানত-ঋণের ভারসাম্যহীনতা বাড়ায় ঝুঁকিতে অ-ব্যাংক আর্থিক খাত

এনবিএফসি খাতে আমানত ও ঋণের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে, একই সাথে বেড়েছে খেলাপি ঋণের ঝুঁকিও। বাংলাদেশ ব্যাংকের এনবিএফসি স্ট্যাটিসটিক ডিভিশন থেকে প্রকাশিত ৩০ জুন ২০২৫ ও ৩১ মার্চ ২০২৫ সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া যায়।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশের অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি) খাত এখন একটি সংবেদনশীল মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দিকে গ্রাহকভিত্তি বাড়ছে, অন্য দিকে ঋণঝুঁকি ও খেলাপি বোঝা বাড়ছে। সেক্টরটির টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শক্ত নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

এনবিএফসি খাত গত কয়েক মাসে আমানত প্রবৃদ্ধির তুলনায় ঋণপ্রবাহ বাড়িয়েছে, যা খাতটির স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, এনবিএফসি খাতে আমানত ও ঋণের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে, একই সাথে বেড়েছে খেলাপি ঋণের ঝুঁকিও। বাংলাদেশ ব্যাংকের এনবিএফসি স্ট্যাটিসটিক ডিভিশন থেকে প্রকাশিত ৩০ জুন ২০২৫ ও ৩১ মার্চ ২০২৫ সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া যায়।

স্থবির প্রতিষ্ঠান সংখ্যা, স্থিতিশীল শাখা : বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যরত এনবিএফসি-এর সংখ্যা ৩৫টিই অপরিবর্তিত রয়েছে। শাখার সংখ্যাও প্রায় ৩০০-তে স্থিতিশীল। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন লাইসেন্স বা কাঠামোগত সম্প্রসারণে গতিশীলতার অভাব খাতটির স্থবিরতাকে নির্দেশ করে।

আমানতে ধীর গতি, গ্রাহক বাড়লেও প্রবৃদ্ধি সীমিত : চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এনবিএফসি খাতে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকায়, যা মার্চ শেষে ছিল প্রায় ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চার মাসে প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম।

তবে এ সময়ে আমানত অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার লাখ ৮০ হাজারে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। গৃহস্থালি (ইনডিভিজুয়াল) আমানতকারীর সংখ্যাও বেড়েছে, বিশেষ করে তরুণ ও মধ্যবয়সী গ্রাহকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঋণ খাতে পরিমাণ বাড়ছে; কিন্তু গ্রাহক কমছে : অন্য দিকে ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ জুন শেষে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৭ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা মার্চের তুলনায় বেড়েছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, ঋণগ্রহীতার সংখ্যা কমে গেছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী- ঋণ অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ চার হাজারে। বিশেষ করে গৃহস্থালি ঋণগ্রহীতার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এটি হয়তো ঝুঁকি বিবেচনায় ঋণ প্রদানে কড়াকড়ি বা বাজারে চাহিদা কমার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বয়সভিত্তিক চিত্র : তরুণ ও মধ্যবয়সীরাই মূল গ্রাহক : আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা গেছে ২৫-৪৪ বছর বয়সী গ্রাহকদের মধ্যে। উচ্চবয়সী গ্রুপে গ্রাহকের সংখ্যা কম হলেও তাদের আমানতের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি, যা ভবিষ্যতের সঞ্চয়প্রবণতার প্রতিফলন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে : এনবিএফসি খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতোমধ্যে রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। একাধিক আর্থিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান কার্যত টিকে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে কয়েকটি দুর্বল এনবিএফসি বন্ধ অথবা একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লিকুইডেশনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

নিয়ন্ত্রক কঠোরতা ও নতুন আইন : নতুন ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন কার্যকরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষায় তদারকি বাড়ানো হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ ঋণপ্রবাহের ওপর বিশেষ নজরদারি চলবে।

বিশ্লেষকদের মত : অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ঋণের প্রবৃদ্ধি যদি আমানতের তুলনায় দ্রুততর থাকে এবং খেলাপির হার কমানো না যায়, তবে ভবিষ্যতে এই খাত বড় ধরনের তারল্যসঙ্কটে পড়তে পারে।